উপমহাদেশের কিংবদন্তি নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ চলচ্চিত্রে ‘অনঙ্গ বউ’ চরিত্রে অভিনয় করে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্যাতি লাভ করেন নন্দিত চিত্রনায়িকা ববিতা।
প্রিয় মানিকদার (সত্যজিৎ রায়ের ডাকনাম) শততম জন্মদিনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তাকে নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করলেন এ গুণী অভিনেত্রী।
ছবির মতো সাজানো শুটিংয়ের সেট
‘অশনি সংকেত’ করার সময় আমার বয়স কম ছিল। ভারতের শান্তিনিকেতন ও বীরভূমে শুটিং করেছিলাম। শান্তিনিকেতনের গ্রামে শুটিংয়ের বাড়িটি দেখে প্রথমে অরিজিনাল বাড়ি মনে করেছিলাম কিন্তু পরে জানলাম, সিনেমার শুটিংয়ের জন্য সেটি তৈরি করা হয়েছে। বাড়িটি ছবির মতো সাজানো ছিল। খড়ের চালে লাউয়ের মাচান, উঠানের পাশে শাকক্ষেত, বাড়ির পাশে অবারিত ধানক্ষেত আর খাঁচার মধ্যে টিয়াপাখি রাখা হয়েছে, একটি কুকুর শুটিং ইউনিটে স্বাভাবিকভাবে ঘোরাঘুরি করছিল আর নিজের মতো করে ফ্রেমের ভেতরে ঢুকছিল আর বোরোচ্ছিল। সব মিলিয়ে ক্যামেরার সামনের মতো পেছনেও অদ্ভূত দৃশ্য ছিল।
মানিকদা রোদের মধ্যে বেশি কাজ করতে না। সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে শুভেন্দু দা থাকলেও বেশিরভাগ শট তিনিই নিতেন। উনার চিত্রনাট্যের বাঁ দিকে স্টোরি বোর্ড আঁকা থাকত। সেটা ধরে ধরে শট নিতেন; আর ডানে থাকত আমাদের সংলাপ।
একটি দৃশ্যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে আমাকে কাঁদতে হবে। শটটা নেওয়ার সময় মানিকদা বলেছিলেন, ‘আমরা কিন্তু কোনো গ্লিাসারিন ব্যবহার করি না। তুমি সৌমিত্রের কাছে আসার পর জড়িয়ে ধরে কাঁদবে।’
দৃশ্যটা দেখার জন্য ইউনিটের সবাই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। আর আমার বুকের ধুকপুকানি বাড়তে থাকে। মনে মনে ভাবছিলাম, ‘যদি কাঁদতে না পারি!’
খুব স্বাভাবিকভাবেই সেই দৃশ্যে অভিনয় করেছিলাম। শট শেষে মানিকদা বলে উঠলেন, খুব ভালো অভিনয় করেছিস।
ঈদের দিন ববিতার কান্না, সেমাই আনালেন ‘মানিকদা’
ঘটনাক্রমে ঈদের দিনও সেই সিনেমার শুটিং পড়েছিল। ঈদের দিন নিজের পরিবার আর ঢাকা শহরের আনন্দঘন মুহূর্তগুলো খুব মিস করছিলাম। শান্তিনিকেতনে ঘরে বসে কাঁদছিলাম। মানিকদা বিষয়টি বুঝতে পেরে তার ছেলে সন্দীপ রায়কে সন্ধ্যায় খাবারের বন্দোবস্ত করতে বলে দিলেন। আমার মন ভালো করতে সেমাই রান্না করে খাওয়ানো হলো। সেটের চারপাশে বাতি জ্বালানোর ব্যবস্থা করা হলো। সত্যি সত্যিই একটা সময় আনন্দিত হলাম।
ছবির নির্মাণ শেষ হওয়ার পর ভারতে মুক্তির আগেই ১৯৭৩ সালে বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভালে ছবিটি প্রদর্শিত হয়েছিল। মানিকদাসহ ছবির অভিনয়শিল্পীরা জার্মানের পথে রওনা হলাম। ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দর গিয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্টের কারণে আমাকে আটকে দেওয়া হলো। কারণ তখনও জার্মানি বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। আমি যেতে পারব না শুনে কাঁদতে কাঁদতে একদম ফ্লোরে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল।
মানিকদা দেখে বললেন, ‘কাঁদিস না, দেখি কী করতে পারি’। ঘণ্টাখানেক ফেস্টিভাল কমিটির চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন সরকারি লোকজনের সঙ্গে কথা বলে সেখান থেকে আমাকে উদ্ধার করলেন। সেবার ফেস্টিভালে গিয়ে জানতে পারি আমাদের ছবি ‘গ্লোন্ডেন বিয়ার’ পুরস্কার জিতেছে।
এরপর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ফেস্টিভাল থেকে আমাদের ডাক আসতে থাকল। সবখানেই সত্যজিৎ রায়ের নায়িকা হিসেবে সম্মান পেয়েছি। বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে বিভিন্ন দেশের ফেস্টিভালে গিয়েছি, স্বীকৃতি পেয়েছি-এটাই আমার জন্য গর্বের।
মানিকদার জন্য পদ্মার ইলিশ আর চিংড়ি
সিনেমার কাজ শেষ হওয়ার পরও মানিকদা ও বৌদির সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। কলকাতায় গেলেই মানিকদার জন্য পদ্মার ইলিশ আর চিংড়ি নিয়ে যেতাম। উনি খুব আদর করতেন আমাকে।
মানিকদার মারফতে বলিউডে কাজের প্রস্তাব পাওয়া
‘অশনি সংকেত’ করার পর বোম্বের কয়েকজন প্রডিউসার মানিকদাকে বলেছিলেন, ববিতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন; আমরা তাকে ছবিতে নেবো। জয়া ভাদুড়ি, শর্মিলা ঠাকুরসহ অনেকেই মানিকদার হাত থেকে বেরিয়েই বোম্বেতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
পরে মানিকদা আমাকে বললেন, বোম্বোর কয়েকজন প্রডিউসার তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। কী করবে? আমি বললাম, দেখি। পরে চিন্তা করলাম, আমি বাংলাদেশের মানুষ বোম্বেতে একা একা থাকব; আমার জন্য বিষয়টি কঠিন হবে। পরে মানিকদাকে বললাম, থাক। বোম্বেতে আর না যাই।
আমার জীবনটা এরকমই থাকুক; ভারতে একটি ছবি করেছি এবং সেটি সত্যজিৎ রায়ের ছবি। সারা পৃথিবী সেই সিনেমা দিয়ে আমাকে চিনেছে। বোম্বেতে গিয়ে কমার্শিয়াল ছবি করার দরকার নাই। অবশ্য তখন ইয়াং ছিলাম। দেখতে শুনতেও খারাপ ছিলাম না (হা হা)।
ওটাই আমার শেষ দেখা। তবে তার সঙ্গে আর কথা হয়নি। তার কয়েকমাস পর তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন পরপারে।