বলা হয়ে থাকে, রেকর্ড গড়া হয় ভাঙার জন্যই। ক্রিকেটের কোনো কোনো রেকর্ড তবু মনে হয় চিরস্থায়ী, কখনোই ভাঙার নয়। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে স্যার জ্যাক হবসের রান ও সেঞ্চুরি সংখ্যা যেমন! ৬১ হাজার ৭৬০ রান ও ১৯৯ সেঞ্চুরি, এখনকার বাস্তবতায় প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এই রেকর্ডের ধারেকাছে যাওয়াও তো অসম্ভব !
অবিশ্বাস্য সেসব কীর্তির পথে হবসের পথচলা শুরু হয়েছিল ১১৫ বছর আগের এই দিনে। ১৯০৫ সালের ২৪ এপ্রিল ওভালে সারের হয়ে তিনি পা রেখেছিলেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে। আজ ওভালের মূল গেট নামকরণ করা হয়েছে তার নামে।
যে পজিশনে তিনি ইতিহাসের অন্যতম সেরা, অভিষেকেও খেলেছিলেন সেই ওপেনিংয়েই। ক্যারিয়ারের প্রথম ইনিংসে করেছিলেন ১৮, দলের ৮৬ রানের ইনিংসে সেটিই ছিল ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ। দ্বিতীয় ইনিংসে করেছিলেন ৮৮, সেটিও দলের সর্বোচ্চ। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। চমকপ্রদ পথচলায় নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার এই আট দশক পরও তার রেকর্ড হয়ে আছে বিস্ময়ের প্রতিশব্দ।
হানিফ মোহাম্মদ থেকে সুনিল গাভাস্কার, কিংবা শচিন টেন্ডুলকার, সবার নামের পাশে বসেছে ‘লিটল মাস্টার’ উপাধি, আর হবসকে বলা হতো, ‘দা মাস্টার!’ প্রথম পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে ‘নাইটহুড’ পেয়েছিলেন তিনিই।
উইজডেনের বর্ষসেরা হয়েছিলেন তিনি ১৯০৯ সালে। ২০০০ সালে জায়গা পান উইজডেনের শতাব্দীর সেরা পাঁচ ক্রিকেটারের তালিকায়।
হবসের অভিষেক ম্যাচে প্রতিপক্ষ দলের অধিনায়ক ছিলেন ক্রিকেটের ‘অমর বুড়ো’ ডব্লু জি গ্রেস। ক্যারিয়ারের গোধূলি বেলায় গ্রেস ঠিক চিনে নিয়েছিলেন ক্রিকেটের নতুন রত্নকে। হবসের ব্যাটিং দেখে বলেছিলেন, “এই ছেলে একদিন বড় কিছু হবে।”
বড় তো বটেই, রেকর্ড বইয়ে হবস হয়ে উঠেছেন সবচেয়ে বড়। ৮৩৪ ম্যাচে রান করেছেন ৫০.৭০ গড়ে। ১৯৯ সেঞ্চুরির পাশে ফিফটি করেছিলেন ২৭৩টি (ফিফটির রেকর্ড ফ্র্যাঙ্ক উলির, ২৯৫টি)। টুকটাক বোলিংও করেছেন মাঝেমধ্যে। হাত ঘুরিয়ে নিয়েছেন ১০৮ উইকেট।মজার ব্যাপার হলো, দীর্ঘদিন পর্যন্ত তার সেঞ্চুরি সংখ্যা ধরা হতো ১৯৭টি! হবস নিজেও যতদিন বেঁচেছিলেন, এটিই জানতেন। পরে ১৯৩০ সালে শ্রীলঙ্কা সফরের দুটি সেঞ্চুরি পরে স্বীকৃতি পায় প্রথম শ্রেণির হিসেবে।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এমন চোখধাঁধানো রেকর্ডের কারণে তার টেস্ট ক্যারিয়ার অনেক সময়ই পড়ে যায় আড়ালে। অথচ এখানেও তিনি সর্বকালের সেরাদের একজন। ইংল্যান্ডের হয়ে ৬১ টেস্টে ৫ হাজার ৪১০ রান করেছেন ৫৬.৯৪ গড়ে।
টেস্টে ওপেনারের ভূমিকায় অন্তত ৪ হাজার রান করেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে হবসের (৫৬.৩৭) চেয়ে বেশি গড় কেবলমাত্র হার্বার্ট সাটক্লিফ (৬১.১১) ও স্যার লেন হাটনের (৫৬.৪৭)। আরেক কিংবদন্তি সাটক্লিফের সঙ্গে হবসের উদ্বোধনী জুটি ক্রিকেটের চিরন্তন লোকগাঁথার অংশ।
কাউন্টিতে হবস আজীবন খেলে গেছেন সারেতে, হয়ে উঠেছেন এই কাউন্টির প্রতিশব্দ। ১৯৯ সেঞ্চুরির ১৪৪টিই করেছেন সারের হয়ে।
হবসের ক্রিকেট প্রেমের শুরু বাবার কারণেই। তার বাবা জন কুপার ছিলেন মাঠকর্মী। মাঝেমধ্যে স্থানীয় ক্লাব ক্রিকেটে আম্পায়ারিংও করতেন। বাবার সঙ্গে থেকে ক্রিকেট দেখেই তার মনে ফুটতে থাকে ক্রিকেট প্রেমের ফুল।
১৯০১ সালে কেমব্রিজের একটি ক্লাবের হয়ে অপেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে যাত্রা শুরু করেন হবস। সারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি হয় ১৯০৩ সালে। তবে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পা রাখার জন্য অপেক্ষা করতে হয় আরও দুই বছর।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে যখন অভিষেক, তার বয়স পেরিয়ে গেছে ২২। আরও কিছুদিন আগে শুরু করতে না পারার খেদ পুষিয়ে দিয়েছেন পরে। ২৯ বছরের ক্যারিয়ার যখন থামল, বয়স তখন ৫২ ছুঁইছুঁই!
তার সমৃদ্ধ ক্যারিয়ারকে দুটি ভাগে আলাদা করা যায়। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত এক অধ্যায়। ১৯১৮ সালে বিশ্বযুদ্ধ শেষের পর আরেকটি। যুদ্ধের কারণে চারটি বছর না হারালে, তার রান ও সেঞ্চুরি কোথায় গিয়ে ঠেকত, কে জানে!
যুদ্ধের আগ পর্যন্ত ৩৮৯ ম্যাচ খেলে ৪২.৩৯ গড়ে করেছিলেন ২৫ হাজার ৫২১ রান। সেঞ্চুরি ৬৫টি, হাফ সেঞ্চুরি ১২৫।
যুদ্ধ যখন শেষ, হবসের বয়স তখন ৩৬ হতে চলেছে। তার ক্যারিয়ারও ততদিনে শেষ হয়ে যেতে পারত। অথচ ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গৌরবদীপ্ত অধ্যায়ের শুরু এরপরই!
যুদ্ধের পর ফিরে আসেন আগের চেয়ে আরও নিখুঁত, ধারাল, পরিণত ও ধারাবাহিক হয়ে। ১৯১৯ সালে আবার যখন ফিরলেন কাউন্টিতে, বয়স ৩৭ প্রায়। তার অসমাপ্ত ক্যারিয়ার যেন পুনর্জন্ম পায় সেই বয়সেই। একের পর এক সেঞ্চুরির করে নিজের ব্যাটসম্যানশিপকে নিয়ে যান এক অনন্য উচ্চতায়।১৯৯টি সেঞ্চুরির ১৩৪টিই এসেছিল তার ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় অধ্যায়ে। এ সময় ব্যাট হাতে রানের স্রোত বইয়েছেন, ৪৪৫ ম্যাচে ৫৮.৮৩ গড়ে করেছেন ৩৬ হাজার ২৩৯ রান।
বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিজের প্রায় অর্ধেক সেঞ্চুরিই করেছেন চল্লিস পেরিয়ে। টেস্ট ক্যারিয়ারও যেন যৌবন দেখেছে চল্লিস পেরিয়েছে। ১৯২৯ সালে মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন ৪৬ বছর ৮২ দিন বয়সে, এখনও যা সবচেয়ে বেশি বয়সে টেস্ট সেঞ্চুরির রেকর্ড। হবস আক্ষরিক অর্থেই যেন বুঝিয়েছিলেন, ‘লাইফ বিগিনস আফটার ফরটি।’
হবসের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা বছর ১৯২৫ সাল। সেবারই তিনি ভেঙে দেন কিংবদন্তি গ্রেসের ১২৪ সেঞ্চুরির রেকর্ড। মৌসুমে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরিও (১৬টি) আসে ওই বছরই। ৪৮ ইনিংসে ৭০.৩২ গড়ে করেন ৩ হাজার ২৪ রান। পরের বছরই করেন ক্যারিয়ারের প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরি। লর্ডসে মিডলসেক্সের বিপক্ষে খেলেন অপরাজিত ৩১৬ রানের ইনিংস।
পরিংসখ্যানই তাকে অমরত্ব দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তবে সেই পরিসংখ্যান এমন জাঁকালো হয়েছে তার অসাধারণ ব্যাটসম্যানশিপের জন্যই। ধ্রুপদি ঘরানার হবসের ব্যালান্স ও পায়ের কাজ ছিল দুর্দান্ত। সব ধরনের ক্রিকেটীয় শটে ছিলেন পারদর্শী। ব্যাকফুটে তাকে মানা হয় সর্বকালের সেরাদের একজন। কাট ও পুল খেলতেন দারুণ, হুক শটে নিয়ন্ত্রণ ছিল অবিশ্বাস্য।
পরিপূর্ণ ব্যাটসম্যান ছিলেন বলেই তিনি ছিলেন বাজে উইকেটের রাজা। সেই যুগে যখন উইকেট ঢেকে রাখা হতো না, রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে অনেক সময়ই উইকেট হয়ে উঠত মরণফাঁদ, সেসব উইকেটে সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান বলে বিবেচিত স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের চেয়েও অনেকে এগিয়ে রাখেন হবসকে।
হবসের দীর্ঘদিনের ব্যাটিং সঙ্গী ও ইংলিশ কিংবদন্তি ওপেনার হার্বার্ট সাটক্লিফ দিয়েছিলেন সব স্বীকৃতি, “খুব বাজে উইকেটে ওর সঙ্গে অনেকবারই ব্যাটিং সঙ্গী ছিলাম। নিঃসংশয়ে বলতে পারি, উইকেট যেমনই থাকুক, সে সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন এবং সব উইকেটে ব্যাটিং করতে পারা আমার প্রজন্মের সেরা ব্যাটসম্যান।”
১৯৩৪ সালের সেপ্টেম্বরে খেলেছেন ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ। জীবনের ইনিংস শেষ হয়ে যায় ১৯৬৩ সালে, ৮১তম জন্মদিনের ৫ দিন পর। তবে সেটি তো কেবলই দেহাবসান, ক্রিকেটে তিনি অমর !