বিদেশি প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য বিদ্যমান নীতি ও আইনের পরিবর্তন দরকার বলে মনে করছেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়।
তিনি বলেছেন, “বিদেশি বিনিয়োগকারীদের প্রতিযোগী হিসেবে না দেখে তাদের সঙ্গে পার্টনারশিপ করে এগিয়ে যেতে হবে। এটা করতে হলে নীতিমালা, আইনের দ্রুত পরিবর্তন প্রয়োজন। করতে পারলে আমরা আরও দ্রুত এগিয়ে যেতে পারব।”
বুধবার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ: সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি’ শীর্ষক এক কর্মশালায় সজীব ওয়াজেদ জয় একথা বলেন।
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের আয়োজনে সংসদ সদস্যদের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে ধারণা দিতে এই কর্মশালার আয়োজন করা হয়। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের এই অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ।
অনুষ্ঠানে সজীব ওয়াজেদ বলেন, “আমরা ডিজিটাল সেক্টরে এখন যেটা ফেইস করছি তা হল বাইরের অনেক কোম্পানি আসতে চায়। বিনিয়োগ করতে চায়। তবে আমাদের অনেকের মধ্যে একটি ধারণা রয়ে গেছে, বিদেশি কোম্পানি এসে খালি প্রফিট নিয়ে চলে যায়। ভেবে দেখুন, আজকে যদি বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশে না আসত থ্রিজি, ফোরজি আমরা বাস্তবায়ন করতে পারতাম না।
“আজকে তারা কিন্তু দেশে এসে শুধু প্রফিট নিয়ে চলে যায়নি। তারা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। কত মানুষের লাভ হয়েছে, তারা ট্যাক্স দিচ্ছে। আজকের যুগ বিশ্বায়নের। নিজেদের আলাদা করে রাখতে পারি না। অর্থনীতি আরও ওপেন করতে হবে। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।”
তিনি বলেন, “সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় যে কোনো কোম্পানি বিনিয়োগ করতে পারে। আমাদের সেদিকে যেতে হবে। সরকার একা সব পারে না। সরকারের সব কিছু করা উচিতও না। কারণ সরকার যদি সব কিছু করতে যায়, তখন আরেকটি বিষয় দাঁড়ায়। সেটা হলো সিস্টেম লস। বেসরকারি খাত লাভ-লোকসান বেশি দেখে। সেখানে সিস্টেম লস কম।”
বিনিয়োগ বাড়াতে মানসিকতার পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, “প্রয়োজন হল আমাদের নিজেদের মাইন্ড সেট পরিবর্তন করা। তরুণ প্রজন্ম এবং সিনিয়রদের মধ্যে একটা জেনারেশন গ্যাপ থাকে। এটা বাস্তব। আমি একটু অনুরোধ করব, আমরা এখন আধুনিক পদ্ধতিতে নিজেদের চিন্তাধারা, ভয় ছেড়ে আরও অন্যান্য যেসব দেশ এগিয়ে গেছে যেমন সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া তাদের কাছ থেকে উদহারণ নিয়ে নিজেদের নিয়ম-আইন-নীতিমালা একটু দ্রুত পরিবর্তন করব।”
তিনি বলেন, “দশ বছর আগে আমাদের দেশে শুধুমাত্র টুজি ছিল। দশ বছরে আমরা শুধু থ্রিজি নয়, ফোরজিতে চলে এসেছি। আর আমাদের এখন পরিকল্পনা আছে যে সারা বিশ্বে যখন ফাইভজি আসবে তার সাথে সাথে এগোনোর।”
টেলিযোগাযোগ নীতিমালা পরিবর্তনের ইঙ্গিত
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে বিদ্যমান টেলিযোগাযোগ নীতিমালা পরিবর্তনের উদ্যোগের কথা জানান প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ।
সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমাদের আইসিটি অবকাঠামো যেটা করেছি-যেমন হাই টেক পার্ক, ডেটা সেন্টার। এগুলো আপনারা দেখেছেন। আরেকটা হল আমাদের টেলিকমিউনিকেশন। আমাদের ডেটা নেটওয়ার্কটাই আইসিটির রাস্তা। আপনারা যেমন নির্বাচনী এলাকায় রাস্তার কাজ করেন। সেই টেলিকমিউনিকেশনের রাস্তার কাজ আমরা করছি। দশ বছর আগে আইসিটি মন্ত্রণালয় বলতে কিছু ছিল না। বাংলাদেশ সংসদ বিভিন্ন আইন করে এই মন্ত্রণালয় আজকে বাস্তবায়ন হয়েছে। সেগুলো আমরা নতুন করে করার সুযোগ পেয়েছি।
“কিন্তু আমাদের টেলিকমিউনিকেশন এখনও সেই ২০ বছর আগের। এটাকে আমাদের নতুন করে মডেল পদ্ধতিতে আনার প্রয়োজন। আমি উদ্যোগ নিয়েছি। প্রায় ১৫ বছরের পরিকল্পনা করেছি। আমরা সম্পূর্ণ নতুন একটা টেলি কমিউনিকেশন পলিসি করব।”
সজীব ওয়াজেদ বলেন, “এটা লংটার্ম ভিশন। এটা না করলে এক পর্যায়ে আমরা আটকে যাব। ইনফ্যাক্ট আমরা প্রায় সেই পর্যায়ে চলে এসেছি। এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, টেলিকমিউনিকেশন পলিসিটাকে সম্পূর্ণ পাল্টাতে হবে।”
গত দশ বছরে আইসিটি খাতে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরে তিনি বলেন, “আপনি যখন ব্যাংক একাউন্ট খুলতে যাবেন বা জমির রেকর্ড নিতে যাবেন। আগে কী করতে হত? আপনার পরিচয়ের প্রমাণ দিতে হত। জন্ম সনদ আনতে হত। ইউএনওর কাছ থেকে সনদ আনতে হত। এখন সেই তথ্য সরকারি ডেটাবেইজে আছে। ন্যাশনাল আইডিতে আছে। এখন আর সনদ আনতে হয় না। এখন শুধু এনআইডি দেবেন।
“এখন আমি এটাকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আপনার এখন আর ন্যাশনাল আইডিও লাগবে না। আপনার আঙুলের ছাপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসবে। এই তথ্য আমাদের নিজস্ব ডেটাবেইজে আছে। সুবিধা কী হচ্ছে? সময় বেঁচে যাচ্ছে।”
সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টা বলেন, “আমরা বর্তমান প্রক্রিয়া শুধু ডিজিটাইজ করছি না। আমরা প্রক্রিয়াটা সরল করে ডিজিটাইজ করছি। সংসদ সদস্যদের অনুরোধ করব, এই পয়েন্টটা মাথায় রাখবেন। আপনারা যখন বিভিন্ন প্রকল্প নেবেন, একটু মনে রাখবেন আগে কীভাবে এসেছে, কী ফাইল, ডকুমেন্ট প্রয়োজন সেভাবেই যে করতে হবে তা কিন্তু না। যেসব কাগজপত্র আর প্রয়োজন নাই আপনারা নতুন পদ্ধতিতে প্রকল্প যাতে হয় সেটা নজর রাখবেন।”
সরকারি সেবার ডিজিটাইজেশনের সুফল তুলে ধরে জয় বলেন, “সরকারি সব কিছু ডিজিটাইজ করা হলে আমরা আসলে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ করতে পারি। সরকারি পদ্ধতি সব ডিজিটাইজ হয়ে গেলে দুর্নীতির সুযোগ থাকে না। অন্তত সরকারি ব্যাপারে। বেসরকারি দুর্নীতি আলাদা বিষয়।
“দশ বছর আগে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল এগুলো দূরের কথা তখন মানুষের খালি একটাই দাবি ছিল- বিদ্যুৎ বিদ্যুৎ। হাউখাউ ছিল। এখন কিন্তু বিদ্যুৎ নিয়ে কোনো কথাই বলে না। বিদ্যুতের দাবি এখন কেউ করে না। আমরা যখন প্রথম ক্ষমতায় আসি তখন সবাই বলেছিল, বিদ্যুতের এত জটিল সমস্যা এটা কোনো সরকার ঠিক করতে পারবে না।”
দশ বছর আগের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “দশ বছর আগে যখন আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের যাত্রা তখন কিন্তু একটা দেশকে কীভাবে ডিজিটাইজ করতে হয়, অল্প সময়ের মধ্যে এই অভিজ্ঞতা কারোরই ছিল না। আমরা নিজেদের মতো করেছি। আমরা বাইরে থেকে পরামর্শক এনে তাদের লাইন অনুযায়ী করিনি। সম্পূর্ণভাবে নিজেদের পরিকল্পনা, নিজেদের তাগিদে করা। প্রথম আমরা ছেড়ে দিয়েছি, মন্ত্রণালয় তোমরা যেভাবে পারো নিজেরা কর। আমরা কিছু নির্দেশনা দিলাম। ট্রেনিং দিলাম। আমরা এখন অনেকটা এগিয়ে এসেছি। আমরা এখন ই-গভর্নমেন্ট মাস্টারপ্ল্যান করছি।
“আমরা দেখেছি প্রায় দেড় হাজারের মতো সরকারি সেবা আছে। তিনশ সেবা ডিজিটাইজড করেছি। প্রায় বারোশ’র মতো বাকি আছে। এখন যেহেতু ক্রিটিকাল কিছু সিস্টেম হয়ে গেছে। এটার ওপর বেইজ করে অন্যান্য সার্ভিস ডিজিটাইজ করা সহজ হয়ে গেছে। আমার অনুরোধ, সংসদ সদস্যদের কাছে আপনারা মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী ডিজিটাইজ করবেন।”
সংসদ সচিব জাফর আহমেদ খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া, প্রধান হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।