ভোটের ডামাডোল পেরিয়ে রাজনৈতিক স্থিতির সঙ্গে অর্থনীতিতে যে স্বস্তি নিয়ে বাংলাদেশ ২০১৯ সাল শুরু করেছিল, ২০২০ সালের শুরুতে তার জায়গায় থাকছে উদ্বেগ।
গত কয়েক বছরে অর্থনীতিতে যে গতির সঞ্চার হয়েছিল, তা যেন অনেকটাই থমকে গেছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ছাড়া অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই এখন নেতিবাচক।
রপ্তানি বাণিজ্যে ধস নেমেছে, রাজস্ব আদায় কমছে, মূল্যস্ফীতি উর্ধ্বমুখী, আমদানি কমছে, তারপরও চাপে আছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বিনিয়োগে। প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়ে ডুবতে বসেছে ব্যাংক খাত। পুঁজিবাজারও পতনের ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না।
সরকারের হিসাবে গত অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি বেড়েছে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ।
বছর শেষে প্রশ্ন থাকছে, অর্থনীতির বর্তমান দশায় এই প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে? খুব বেশি আশাবদী হতে পারছেন না অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক বলেন, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস ‘বেশ খারাপ’ গেছে। বাকি ছয় মাসে বড় ধরনের উন্নতি না হলে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন ‘খুব কঠিন’ হবে।
“সত্যিই সংকটের মুখে পড়েছে আমাদের অর্থনীতি। অর্থনীতির স্বাস্থ্য এখন খুবই দুর্বল। গত কয়েক বছরে যতোটা সবল হয়েছিল সেটা আর এখন নেই। দিন যত যাচ্ছে দুর্বলতা বাড়ছে।”
কেন এমন হল? ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুরের ধারণা, গত কয়েক বছরের সাফল্যের ‘আত্মতুষ্টি’ এর একটি কারণ।
“অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে যে ওষুধ খাওয়ানো প্রয়োজন ছিল সেটা খাওয়াইনি। অর্থাৎ যে রিফর্মসগুলো (সংস্কার) জোরালোভাবে চালানো উচিৎ ছিল সেটা করিনি। উল্টো কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ব্যাংক খাতের অবস্থা আরও খারাপ করেছে।”
আর ব্যাংক খাতের এই নাজুক দশাই অর্থনীতির স্বাস্থ্যকে ‘দুর্বল’ থেকে ‘দুর্বলতর’ করছে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
“সবচেয়ে খারাপ অবস্থা রাজস্ব আদায়ে। এবার প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৪০ শতাংশ। এখন পর্যন্ত (অক্টোবর) মাত্র ৪ শতাংশ বেড়েছে। এখানে বড় ঘাটতি থাকলে উন্নয়ন কাজসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”
বড় ধাক্কা রপ্তানিতে
টানা চার মাস ধরে রপ্তানি আয় কমায় ২০১৯ সালে বড় ধাক্কা খেয়েছে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান এই সূচক। আগামী দিনগুলোতেও ‘এই নেতিবাচক’ ধারা অব্যাহত থাকবে এমন আশঙ্কার কথা প্রকাশ করে সরকারের সহায়তা চেয়েছে রপ্তানি বাণিজ্যের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরা
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে এক হাজার ৫৭৭ কোটি ৭০ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।গত বছরের একই সময়ে রপ্তানির অংক ছিল এক হাজার ৭০৭ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। এবার এই পাঁচ মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক হাজার ৮০৫ কোটি ডলার।
এ হিসাবে চলতি বছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। আর লক্ষ্যের চেয়ে কমেছে ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
সর্বশেষ নভেম্বর মাসে রপ্তানি আয় কমেছে প্রায় ১১ শতাংশ। এই মাসে লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে ১৮ শতাংশ।
সার্বিক পরিস্থিতিকে ‘খুবই খারাপ’ হিসেবে চিহ্নিত করে বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, “দিন যত যাচ্ছে পরিস্থিতি ততই খারাপ হচ্ছে। আমাদের সব অর্ডার ভিয়েতনাম-ভারতে চলে যাচ্ছে। সরকারের পলিসি সাপোর্ট ছাড়া এই অবস্থা থেকে আমরা উত্তরণ ঘটাতে পারব না।”
ইতোমধ্যে ৬০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছে তথ্য দিয়ে রুবানা বলেন, “আমরা রপ্তানি খাতের জন্য টাকা-ডলারের আলাদা বিনিময় রেট চাই। আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সেটা ঠিক করে দিতে হবে। সেইসঙ্গে আমরা নগদ সহায়তা ঘোষণার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করছি।”
বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে টাকার বিপরীতে ডলারের মান ৮ থেকে ১০ শতাংশ বাড়ানোর পক্ষে আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন, “চীন, ভারত, ভিয়েতনামসহ প্রতিযোগী দেশগুলো তাদের রপ্তানিকারক ও প্রবাসীদের সুবিধা দিতে তাদের মুদ্রার মান কমিয়েছে। ডলার শক্তিশালী করা ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো বিকল্প পথ খোলা নেই। অর্থনীতির স্বার্থেই এটা করতে হবে।”
তবে টাকার মান কমানোর কোনো ‘সম্ভবনা নেই’ জানিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত ১৮ ডিসেম্বর সাংবাদিকদের বলেছেন, “আমরা স্পেসেফিক খাতে প্রণোদনা দেব। তাহলে ওই খাতটি বেগবান হবে। রপ্তানি বাণিজ্য বাড়াতে আমরা তৈরি পোশাক খাতকে প্রণোদনা দিয়েছি। আরও দিতে হলে দেব।”
গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৪ হাজার ৫৩৫ কোটি ৮২ লাখ (৪০.৫৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করে। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানির মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৫৫০ কোটি (৪৫.৫০ বিলিয়ন) ডলার।
আমদানিও কমছে
বেশ কিছুদিন ধরেই আমদানিতে ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর অর্থ হল, দেশের মানুষের ভোগ ব্যয় কমেছে এবং নতুন শিল্প স্থাপনে বিনিয়োগ কমেছে।
গত অর্থবছর আমদানি ব্যয় আগের বছরের চেয়ে ১ দশমিক ৭৮ শতাংশ বেড়েছিল। কিন্তু চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, এই চার মাসে শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ। জ্বালনি তেল আমদানি কমেছে ১৫ শতাংশ। আর শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ।
লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি বাড়ছে
রপ্তানি আয়ে বড় ধাক্কার কারণে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) ঘাটতি বাড়ছে।
জুলাই-অক্টোবর সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩০ কোটি ৪০ লাখ ডলার। অথচ অগাস্ট মাস শেষেও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকে ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।
চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ঘাটতি ছিল ৭৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার। চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) তা বেড়ে হয়েছে ১৩০ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
অথচ অর্থবছর শুরু হয়েছিল ‘স্বস্তির’ মধ্য দিয়ে ২৪ কোটি ডলারের উদ্বৃত্ত নিয়ে। অগাস্ট পর্যন্ত সেই উদ্বৃত্ত ধরে রাখা গিয়েছিল। কিন্তু সেপ্টেম্বর শেষে আবারও ঘাটতি দেখা দেয়।
নিয়মিত আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য আয়-ব্যয় চলতি হিসাবের অন্তর্ভুক্ত। এই হিসাব উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হল, নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।
সুখবর শুধু রেমিটেন্সে
সব কিছুর পরও প্রবাসীরা তাদের উপার্জিত টাকা দেশে পাঠিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বড় ভূমিকা রাখছেন। চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রেমিটেন্স এসেছে ৭৭১ কোটি (৭.৭১ বিলিয়ন) ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২২ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি।
এ বছর থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। আর তা রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়াতে সহায়ক হচ্ছে বলেই মনে করেন আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন, “তবে আমি প্রণোদনা দিয়ে কোনো কিছু বাড়ানোর পক্ষে নই। বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রণোদনা দিতে গিয়ে কিন্তু মোটা অংকের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। তার থেকে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করে, অন্যান্য দেশের মত টাকার মান কমিয়ে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকাই হবে আসল কাজ।”
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বৃদ্ধি এবং আমদানি ব্যয় কমার পরও চাপে রয়েছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ। বৃহস্পতিবার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩২ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। ২০১৭ সালের পর রিজার্ভ আর কখনও ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়নি।
মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী
পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) এবার নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ০৬ শতাংশ, গত বছরের নভেম্বর মাসে তা ছিল ৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ চার বছর পর মূল্যস্ফীতি ৬ এর ঘর অতিক্রম করল। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ১০ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে বেঁধে রাখার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
অক্টোবরের ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ থেকে নভেম্বরে মূল্যস্ফীতির বাড়ার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রেখেছে খাদ্য খাত। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান আরও সুনির্দিষ্ট করে বলেছেন, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির প্রধান কারণ পেঁয়াজ।
নভেম্বরে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ৪১ শতাংশ। গত বছরের একই মাসে যা ছিল ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ।
গত সেপ্টেম্বরের শেষে ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দিলে হু হু করে বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। দুই মাসের মধ্যে এই নিত্যপণ্যের দর ৩০ টাকা থেকে আড়াইশ টাকায় উঠে যায়। তবে নতুন পেঁয়াজ ওঠায় তা এখন কমে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
রাজস্ব আদায় লক্ষ্যের চেয়ে কম
চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে ৬৫ হাজার ৯৬ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা কম। গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে আদায় হয়েছিল ৬২ হাজার কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের এই চার মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি রাজস্ব আদায় হলেও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এই অংক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ১৯ শতাংশের বেশি। আর মূল্য বাজেটের চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি।
এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলছেন, আমদানি-রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার প্রভাব পড়ছে রাজস্ব আদায়ে।
পুরো বছরের ঋণ ৫ মাসেই
এদিকে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। চলতি অর্থবছরের পুরো সময়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। কিন্তু তার প্রায় পুরোটা নেওয়া হয়ে গেছে পাঁচ মাসেই। ১ জুলাই থেকে ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার ব্যাংক থেকে ধার নিয়েছে ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা।
সব মিলিয়ে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের নেওয়া মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ১ লাখ ১১ হাজার ৪১২ কোটি টাকা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৪৩ হাজার ৮২২ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম রাজস্ব আদায় এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে বাধ্য হয়েই সরকারকে ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ নিতে হচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।
আর তাতে সরকারের বাজেট ব্যবস্থাপনা ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে বলে সতর্ক করে তিনি বলেছেন, রাজস্ব আদায় না বাড়লে এই ঝুঁকি আরও বাড়বে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও এ বাস্তবতা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, “এতোদিন প্রথমে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়া হত। পরে ঘাটতি থাকলে ব্যাংক থেকে নেওয়া হত। কিন্তু এবার বিপরীত প্রক্রিয়া করা হয়েছে। প্রথমে ব্যাংক থেকে নেওয়া হচ্ছে; আর ব্যাংক থেকে তো সরকার নেবেই। রাজস্ব আয় নিয়ে সমতা আনতে পারিনি, চাহিদা মোতাবেক না আসায় ঘাটতি বাজেট করতে হয়, ঘাটতি যেটা আছে এজন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে।”
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য ঘেটে দেখা যায়, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে ৫ হাজার ৫১২ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা।
বিনিয়োগ সেই তিমিরেই
রাজনৈতিক অস্থিরতা, জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-অবরোধ না থাকায়, বিদ্যুৎ-গ্যাস সরবরাহের উন্নতি হওয়ায় এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজটের সমস্যা কমে আসায় সুফল পাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। কিন্তু এর তেমন কোনো প্রভাব বিনিয়োগে দেখা যাচ্ছে না।
অক্টোবর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ০৪ শতাংশে নেমে এসেছে।গত অর্থবছর শেষে যা ছিল ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ। আর এটাকেই এ মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান সমস্যা বলে মনে করছেন আহসান এইচ মনসুর।
“মরার উপর খরার ঘা আরকি! এমনিতেই বিনিয়োগের অবস্থা খারাপ, তার উপর সরকার ব্যাংক থেকে টাকা ধার নেওয়ায় সংকট আরও বেড়েছে।”
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ এর ঘরে, সেই প্রবৃদ্ধি এই দশ বছরে বেড়ে ৮ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা বলছে, গত দশ বছরে দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ জিডিপির আনুপাতিক হারে বেড়েছে সামান্যই।
আহসান মনসুর বলেন, “একটা বিষয় সবাইকে মনে রাখতে হবে, বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না। আর কর্মসংস্থান বাড়ানোই এখন আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।”
পুঁজিবাজারের করুণ দশা
পুঁজিবাজারের অবস্থা আরও করুণ। ২০১০ সালের ধসের পর নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। তালিকাভুক্ত কোম্পানির এক চতুর্থাংশের দাম অভিহিত মূল্যের (ফেইস ভ্যালু, ১টাকা) নিচে নেমে এসেছে। বেশ কিছু কোম্পানির দর ৫ টাকার কম।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বুধবার লেনদেন ছিল ৩০৫ কোটি টাকার সামান্য বেশি। অথচ ২০১০ সালের উত্তাল সময়েও এ বাজারে লেনদেন ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি ছিল। ২০১৯ সালের শুরুতেও হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে।
ব্যাংক খাত ভঙ্গুর অবস্থায়
আহসান মনসুর বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) একটি শক্তিশালী রিপোর্ট দিয়েছে, তাতে সরকারের কিছুটা হলেও টনক নড়েছে বলে মনে হচ্ছে।
“ওই প্রতিবদেনে আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার প্রবণতা অত্যন্ত গভীর। প্রভাবশালী ও ধনী কিছু ব্যবসায়ী ঋণ ফেরত দেওয়ার কোনো তাগিদই অনুভব করেন না। ওপর মহলেও তাদের ভালো যোগাযোগ আছে। ক্ষমতাধর এই ঋণগ্রাহকরা এখন বাংলাদেশে আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নিচ্ছে।”
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঋণ কেলেঙ্কারি-অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেই ব্যাংকিং খাতের এই দুরাবস্থা হয়েছে বলে মনে করেন আইএমএফের কর্মকর্তা হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর।
আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি একদিকে দুর্বল, অন্যদিকে ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের আচরণ ‘বেপরোয়া’। নিয়ম ভাঙলে এখানে শাস্তি হয় না। বরং খেলাপিদের এখানে আড়াল করে রাখা হচ্ছে।
সরকারের নানা পদক্ষেপের পরও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মন্দ ঋণের অংক দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকায়, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১২ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। নয় মাসের ব্যবধানে তা বেড়েছে ২২ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা। অবশ্য আইএমএফ, স্থানীয় অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকাররা বলছেন, প্রকৃত হিসাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি।
বিভিন্ন সময়ে বিশেষ ব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। সরকারের নির্দেশে বারবার ঋণ পুনঃতফসিল করার উদাহরণও আছে। ২০১৫ সাল থেকে শুরু হয়েছে বড় অংকের খেলাপি ঋণের পুনঃতফসিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে এ রকম বিশেষ নির্দেশিত হিসাবে থাকা ঋণের পরিমাণ ২৭ হাজার ১৯২ কোটি টাকা।
আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নিয়ে জুন পর্যন্ত আরও ২১ হাজার ৩০৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত করে দিয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক। এই সব হিসাবে নিলে বাংলাদেশে এখন মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা।
আইএমএফ এসব ঋণ অন্তর্ভুক্ত করেই খেলাপি ঋণের হিসাব করতে বলেছে সরকারের কাছে দেওয়া প্রতিবেদনে।