একটু তালি, একটু গান। ইংলিশ আদবকেতায় দর্শক সমর্থনের রূপ অনেকটা এমনই। কিন্তু দল যখন বদলেছে, সমর্থকদেরও তো বদলাতে হয়! গ্যালারিতে তাই গর্জন হলো, গলা ছেড়ে গান চলল সমানে। ২২ গজে ক্রিকেটারদের ব্যাট-বলের পারফরম্যান্সও হলো ছন্দময়। মাঠ আর গ্যালারির যুগলবন্দী মিলিয়ে এজবাস্টনে বয়ে গেল যেন ইংলিশ জোয়ার। তাতে ভেসে গেল বর্তমান চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া। ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে ফাইনালে উঠল ইংল্যান্ড।
বিশ্বকাপ ইতিহাসের সফলতম দল অস্ট্রেলিয়া আগে সাতবার সেমি-ফাইনাল খেলে হারেনি কখনই। তবে ইংল্যান্ড দল তো গত চার বছরে অনেক ইতিহাসই লিখিয়েছে নতুন করে! এবার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের অচেনা তেতো স্বাদ উপহার দিল তারা। দ্বিতীয় সেমি-ফাইনালে ৮ উইকেটের জয়ে পা রাখল ফাইনালে।
ক্রিকেটের জন্ম যেখানে, ওয়ানডে ক্রিকেটের জন্মও, সেই ইংল্যান্ড এখন কেবল এক ধাপ দূরে অধরা বিশ্বকাপ ট্রফির ছোঁয়া পাওয়া থেকে। রোববার লর্ডসের ফাইনালে ইংলিশদের প্রতিপক্ষ নিউ জিল্যান্ড, কখনও শিরোপার স্বাদ পায়নি তারাও। বিশ্বকাপ ক্রিকেট তাই নিশ্চিতভাবেই পাচ্ছেন নতুন চ্যাম্পিয়ন।
বার্মিংহামে বৃহস্পতিবার সেমি-ফাইনালে ব্যাটে-বলে দাপুটে পারফরম্যান্সেই জিতেছে ইংলিশরা। টস জয়ী অস্ট্রেলিয়োকে গুটিয়ে দেয় তারা ২২৩ রানে। রান তাড়ায় জয় ধরা দিয়েছে ১০৭ বল বাকি রেখে!
নতুন বলে আগুন ঝরিয়ে সুরটা বেঁধে দিয়েছিলেন ক্রিস ওকস ও জফরা আর্চার। গতি, বাউন্স আর ছোট সুইং মিলিয়ে কাঁপিয়ে দেন তারা অস্ট্রেলিয়ার টপ অর্ডার। দুই পেসার ভাগাভাগি করেছেন ৫ উইকেট। মাঝে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি উইকেট নিয়েছেন লেগ স্পিনার আদিল রশিদ।
বোলিংয়ের মতো ব্যাটিংয়ের শুরুটাও হয় তাদের দারুণ। জেসন রয় ও জনি বেয়ারস্টোর দুর্দান্ত উদ্বোধনী জুটিই দলকে অনেকটা এগিয়ে নেয় জয়ের পথে। শেষ করে দেয় অস্ট্রেলিয়ার লড়াইয়ের সম্ভাবনা।
টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা অস্ট্রেলিয়া মাঝারি স্কোর গড়তে পেরেছিল মূলত স্টিভেন স্মিথের সৌজন্যে। উইকেটে গিয়েছিলেন দ্বিতীয় ওভারে। শুরুর বিপর্যয়ে দলকে সামলে, এক প্রান্ত আগলে রেখে এগিয়ে নেন দলকে। ৪৮তম ওভারে রান আউটে ফেরার আগে করেন ৮৫ রান।
টস জিতলে আগে ব্যাটিংয়ের ইচ্ছে ছিল ওয়েন মর্গ্যানেরও। তবে নতুন বলের দুই বোলারের বোলিং দেখে নিশ্চয়ই টস হারকে আশীর্বাদ মনে হয়েছে ইংল্যান্ড অধিনায়কের!
ইনিংসের প্রথম বলে বাউন্ডারিতে শুরু করেছিলেন ডেভিড ওয়ার্নার। এরপর থেকেই ওকস ও আর্চারের দাপট।
ইনিংসের দ্বিতীয় আর নিজের প্রথম ওভারের প্রথম বলেই আর্চার ফেরান অ্যারন ফিঞ্চকে। টুর্নামেন্টে পাঁচশর বেশি রান করা অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক ফিরেছেন শূন্য রানে। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা আরেক ওপেনারকে ওয়ার্নারকে ৯ রানে থামায় ওকসের বাড়াতি লাফানো বল।
চোট পাওয়া শন মার্শের বদলি হিসেবে বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পাওয়া পিটার হ্যান্ডসকম সুযোগ পেয়ে যান সেমি-ফাইনালে খেলার। কিন্তু রাঙাতে পারেননি বিশ্বকাপ অভিষেক। ওকসকে শরীর থেকে দূরে ড্রাইভ খেলতে গিয়ে হয়েছেন বোল্ড। সপ্তম ওভারে অস্ট্রেলিয়ার রান তখন ৩ উইকেটে ১৪।
ওকস ও আর্চারের বোলিংয়ে অস্ট্রেলিয়া ছিল প্রায় দম বন্ধ অবস্থায়। দুই প্রান্ত থেকে দুজন মিলে টানা করেছেন ১১ ওভার। অস্ট্রেলিয়ার রান ছিল ৩ উইকেটে ২৮।
বোলিং পরিবর্তনের পর একটু শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পান ব্যাটসম্যানরা। স্মিথ ছন্দ পেতে শুরু করেন। ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন পেয়ে পাঁচে নামা অ্যালেক্স কেয়ারিও ইতিবাচক ব্যাটিংয়ে সঙ্গ দেন।
দুজনের জুটিতে ঘুরে দাঁড়ায় অস্ট্রেলিয়া। আর্চারের বাউন্সার কেয়ারির থুতনিতে ছোবল দিয়ে রক্তাক্ত করার পর ব্যান্ডেজ বেঁধে ব্যাটিং চালিয়ে যান এই কিপার ব্যাটসম্যান। ১০৩ রানের জুটির শেষটা অস্ট্রেলিয়ার জন্য হতাশার। দারণ খেলতে খেলতেই রশিদকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে সীমানায় ধরা পড়েন ৪৬ রান করা কেয়ারি।
ওই ওভারেই আসে আরেকটি উইকেট। মার্কাস স্টয়নিসের বাজে সময় দীর্ঘায়িত হয় রশিদের গুগলিতে বিভ্রান্ত হয়ে।
সাতে নামা ম্যাক্সওয়েল চেষ্টা করেছেন নিজের মতো ব্যাটিংয়েই। তাকে ফেরাতে আর্চারকে আক্রমণে ফেরান মর্গ্যান। আর্চার অধিনায়ককে কাঙ্ক্ষিত উইকেট এনে দেন দারুণ এক স্লোয়ারে।
এক প্রান্তে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকা স্মিথ এরপর সঙ্গী পান মিচেল স্টার্ককে। দুজন মিলে দুইশ পার করান দলকে। অষ্টম উইকেটে গড়ে ওঠে ৫১ রানের জুটি।
শেষ দিকে হয়তো রান আরেকটু বাড়াতে পারতেন স্মিথ। কিন্তু কিপার জস বাটলারের সরাসরি থ্রো তাকে থামিয়ে দেয় ৮৫ রানে। পরের বলেই বিদায় নেন ২৯ রান করা স্টার্ক। শেষ দিকে তাই আর বেশি বাড়েনি অস্ট্রেলিয়ার রান।
আগের সেমি-ফাইনালে এমন মাঝারি পুঁজি নিয়েই ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন আপকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল নিউ জিল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়ার পেস আক্রমণও দারুণ, তাই তাদের ছিল আশা। কিন্তু সেই আশা পিষ্ট হয় রয় ও বেয়ারস্টোর ব্যাটে।
রানরেটের চাপ ছিল না, তাই ইংলিশদের দুই ওপেনার বিস্ফোরক শুরুর চেষ্টা করেননি। ঝুঁকিবিহীন ব্যাটিংয়েই ১০ ওভারে তোলেন ৫০ রান।
সাময়িক স্নায়ুর চাপ কেটে যাওয়ার পর হাত খোলেন রয়। রান বাড়তে থাকে তরতরিয়ে। বেয়ারস্টোও সুযোগ মতো খেলতে থাকেন শট।
অস্ট্রেলিয়ার মূল স্ট্রাইক বোলার মিচেল স্টার্কের এক ওভারে আসে তিন বাউন্ডারি। জুটি ভাঙতে স্টিভেন স্মিথের অনিয়িমত লেগ স্পিন আনা হয়, রয় ছক্কায় ওড়ান পরপর তিন বলে।
দুজনকে শেষ পর্যন্ত আলাদা করতে পারেন স্টার্ক। দারুণ এক ডেলিভারিতে ফেরান ৩৪ রান করা বেয়ারস্টোকে। ভাঙে ১০৪ বলে ১২৪ রানের জুটি।
এবারের আসরে স্টার্কের সেটি ২৭তম উইকেট। এক বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি উইকেটের রেকর্ডে ছাড়িয়ে গেছেন পূর্বসূরী গ্লেন ম্যাকগ্রাকে।
রয় অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছুটছিলেন সেঞ্চুরির পথে। কিন্তু তাকে থামতে হয় আম্পায়ার কুমার ধর্মসেনার বাজে এক সিদ্ধান্তে। হতাশায় উইকেটই ছাড়তে চাচ্ছিলেন না এই ওপেনার। বেয়ারস্টো আগেই রিভিউ নষ্ট করে যাওয়ায় সুযোগ ছিল না রিভিউয়ের। ৯ চার ও ৫ ছক্কায় ৬৫ বলে ৮৫ রান নিয়েই মাঠ ছাড়তে হয় তাকে।
ইংল্যান্ড ততক্ষণে জয়ের রথে উঠে গেছে। জো রুট ও ওয়েন মর্গ্যান অনায়াসেই দলকে পৌঁছে দেন কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়। ৪৬ বলে ৪৯ রানে অপরাজিত রুট; ৩৯ বলে ৪৫ মর্গ্যান। উত্তুঙ্গ গ্যালারির গগণবিদারী আনন্দ চিৎকারে ঘোষিত হলো যেন জয়ের বার্তা। ২৭ বছর পর বিশ্বকাপ ফাইনাল!
ম্যাচ শেষ হতে না হতেই শুরু হলো বার্মিংহামের আকাশের কান্না। দর্শক-ক্রিকেটার, সব মিলিয়ে ইংলিশরা অবগাহন করল যেন আনন্দধারায়। ৫ বারের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার জন্য তা হতাশার বর্ষণ!
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
অস্ট্রেলিয়া: ৪৯ ওভারে ২২৩ (ওয়ার্নার ৯, ফিঞ্চ ০, স্মিথ ৮৫, হ্যান্ডসকম ৪, কেয়ারি ৪৬, স্টয়নিস ০, ম্যাক্সওয়েল ২২, কামিন্স ৬, স্টার্ক ২৯, বেহরেনডর্ফ ১, লায়ন ৫*; ওকস ৮-০-২০-৩, আর্চার ১০-০-৩২-২, স্টোকস ৪-০-২২-০, উড ৯-০-৪৫-১, প্লাঙ্কেট ৮-০-৪৪-০, রশিদ ১০-০-৫৪-৩)।
ইংল্যান্ড: ৩২.২ ওভারে ২২৬/২ (রয় ৮৫, বেয়ারস্টো ৩৪, রুট ৪৯*, মর্গ্যান ৪৫*; বেহরেনডর্ফ ৮.১-২-৩৮-০, স্টার্ক ৯-০-৭০-১, কামিন্স ৭-০-৩৪-১, লায়ন ৫-০-৪৯-০, স্মিথ ১-০-২১-০, স্টয়নিস ২-০-১৩-০)।
ফল: ইংল্যান্ড ৮ উইকেটে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: ক্রিস ওকস