চলতি জুলাই মাস থেকে একদফার আন্দোলন শুরু করতে চায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। আর এ আন্দোলন মোকাবিলায় প্রস্তুত বলে জানিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে এ মাসে ঢাকা সফরে আসছে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল। ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধিদলও এ মাসে ঢাকা সফরে আসতে পারে। তারা নির্বাচন-পূর্ব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে মতামত দেবেন। তাদের মতামতের ওপর নির্ভর করবে ইইউ’র নির্বাচন পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়টি। তাই সরকার ও বিরোধী দলের শোডাউন এবং সংকট নিরসনে বিদেশি কূটনীতিকদের এই দ্বিমুখী চাপে অস্থির হয়ে পড়তে পারে জুলাইয়ের রাজনীতি। বিশ্লেষকদের মতে, ভূরাজনৈতিক কারণে এ মাস থেকে নানামুখী আরও চাপ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ ব্যাপারে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘ঈদের পরে আন্দোলনে যাবে-এই ধরনের ঘোষণা দিয়ে বিএনপি কয়েকটি ঈদ পার করেছে। এবার তারা কতদূর পারবে জানি না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বলছে, তারা মাঠের দখল ছাড়বে না। তাই দিন যত যাবে পরিস্থিতি ততই উত্তপ্ত হতে থাকবে। অতীতের মতো সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। আগামী কয়েকটা মাসে অনেক খেলা হবে।’ মার্কিন প্রতিনিধিদলের ঢাকা সফরে সমঝোতার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সমঝোতার সম্ভাবনা একেবারেই শূন্য। সরকারি দল আওয়ামী লীগ তো ইতোমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতাকে তাদের (সরকার) বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসাবে উল্লেখ করেছে। তবে একটা ভালো নির্বাচনের জন্য তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) চাপ রয়েছে, তাই বিএনপি একটু আশা দেখছে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, দেশে যে রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছে সেখানে সমঝোতা না হলে পরিস্থিতি সহিংস হয়ে উঠবে। সমঝোতা না হলে তা সবার জন্যই হবে অমঙ্গলজনক। বিশেষ করে এই পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের জন্য দুর্ভোগ বয়ে আনবে। এজন্য অবশ্যই আমাদের দেশের রাজনীতিকরা দায়ী হবেন। দেশে এই ধরনের পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়, আগামীতে যাতে একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়-সেজন্য উভয়পক্ষ দেশপ্রেম প্রদর্শন করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছবেন বলে আমরা আশা করছি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম. হুমায়ুন কবির রোববার যুগান্তরকে বলেন, রাজনীতির মাঠে বিএনপি একদফার আন্দোলন শুরু করতে যাচ্ছে। অপরদিকে আওয়ামী লীগ তা মোকাবিলা করবে বলে ঘোষণা দিচ্ছে। ফলে সমঝোতার কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। অপরদিকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নানামুখী বিদেশি চাপ বিদ্যমান রয়েছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতিও এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে। এখন আবার এ মাসে আসছে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল।
তিনি বলেন, এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) অনেক আগে থেকেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছে যে, জুলাই মাসে তারা নির্বাচনি পরিবেশ পর্যালোচনায় প্রতিনিধিদল পাঠাবে। নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে তার মানদণ্ডের জন্য ইইউ’র উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। ইইউ প্রতিনিধিদল সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলবে। ইইউ’র সঙ্গে বাংলাদেশের জিএসপি প্লাস সুবিধা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে সেটা পেতে সহায়ক হবে। ফলে সবকিছু মিলিয়ে জুলাই মাস থেকে সরকারের ওপর চাপ বাড়বে। হুমায়ুন কবির বলেন, এসব চাপ সরকার কতটা সফলভাবে ফেস করতে পারবে সেটিই এখন দেখার বিষয়। তবে সমঝোতা না হলে সংকট নিঃসন্দেহে ঘনীভূত হবে।
এদিকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে, সব মিলিয়ে রাজনীতির এক টার্নিং পয়েন্ট হতে যাচ্ছে জুলাই মাস। দিন গণনায় জুলাই শেষে হাতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর সময় বেশি নেই। এর আগে রয়েছে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের বিষয়টি। নির্বাচনের প্রস্তুতি সবই শুরু হয়ে যাবে এই সময়ে। এ অবস্থায় বিরোধী দলগুলো চাইছে তাদের একদফার আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করে নিতে। আর সরকার চাইছে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনের মাঠে নামাতে। আওয়ামী লীগ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সতর্ক নজরে রেখেছে বিরোধী দলগুলোর অবস্থান ও কর্মসূচি। নেতারা জানিয়েছেন, জুলাই থেকে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বাড়ানো হবে মাঠের কর্মসূচি। বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন-কর্মসূচির বিপরীতে নিয়মিত সভা-সমাবেশ করা হবে। শান্তি সমাবেশের বাইরে জনসভা ও নির্বাচনি প্রচার সভা হবে। এছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন জেলা সফর করবেন। এসব কর্মসূচি ঘিরে নেতাকর্মীদের চাঙা রাখার চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ।
ফলে দুপক্ষের পালটাপালটি অবস্থানের কারণে উত্তপ্ত হয়ে পড়তে পারে রাজনীতির মাঠ। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলছে নানা সমীকরণ। এই পরিস্থিতিতে সব মহলেই তৈরি হয়েছে তীব্র কৌতূহল। সবার প্রশ্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট কি আরও ঘনীভূত হবে? নাকি বিদেশি কূটনীতিকদের চেষ্টায় এই সংকট থেকে উত্তরণে কোনো পথ বের হয়ে আসতে পারে?
উদ্ভূত এই পরিস্থিতিতে রোববার সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে সংলাপের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংলাপে বসতে বিএনপি রাজি থাকলে বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হবে। একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, আপনি ফখরুল ইসলামকে (বিএনপি মহাসচিব) জিজ্ঞেস করেন তারা সংলাপ করতে রাজি আছে কিনা। এরপর আমরা বিবেচনা করব। কারণ আমাদের রাষ্ট্রপতি একবার ডেকেছিলেন, নির্বাচন কমিশন দুবার তাদের ডেকেছে। তারা আসেনি। তাদের অ্যাটিচিউডটা কী সেটা আগে জানান।
একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপির একদফার আন্দোলনকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটগুলো আন্দোলনের নামে সহিংসতা চালালে তা দলীয়ভাবে মোকাবিলা করা হবে। তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে বলেন, কারও প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী দেশে নির্বাচন হবে না। বিএনপি এবং বিরোধী দলের কর্মসূচি রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত মাঠে থাকবে তার দল আওয়ামী লীগ।
শনিবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে জানান, শিগগির তারা একদফার আন্দোলন শুরু করবেন। বিএনপির দশ দফা ও সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর দফাগুলো মিলিয়ে একদফা করা হয়েছে। অবৈধ সরকারের পদত্যাগ, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল করে নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে তারা চূড়ান্ত এ আন্দোলনে যাচ্ছেন।
বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য। আগামী সপ্তাহে একদফা আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হতে পারে। একই সঙ্গে দেওয়া হবে রাষ্ট্র সংস্কারের ‘যৌথ রূপরেখাও’। তবে এই ঘোষণা এক মঞ্চ থেকে নয়, আসবে পৃথক মঞ্চ থেকে। চলতি জুলাই মাসের শেষদিকে অভিন্ন কর্মসূচি শুরু করবে দলগুলো। এ লক্ষ্যে এ সপ্তাহে আবারও সমমনাদের সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে বিএনপির। দলটির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, একদফার আন্দোলনের পাশাপাশি ১৯৯১ সালের আদলে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখার খসড়া প্রণয়নে কাজ শুরু করেছে দলটি।
এর আগে ২৪ মে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য ভিসানীতি ঘোষণা করে। তারও আগে তারা র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। এছাড়া দেশটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মানবাধিকার লংঘনকারী কোনো সেনা ও পুলিশকে শান্তিরক্ষায় স্থান দেওয়া হবে না। এসব নিষেধাজ্ঞা ও হুঁশিয়ারির পর থেকে নতুন মাত্রায় রাজনীতির মাঠ সরগরম হতে শুরু করে। বিএনপি বলছে, ক্ষমতাসীনদের লক্ষ্য করে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আর আওয়ামী লীগ বলছে, সরকার নয়-বিএনপিকে টার্গেট করেই যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। এদিকে বাংলাদেশে মানবাধিকার, গণতন্ত্রসহ নানা ইস্যুতে প্রশ্ন তুলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিবৃতি দিয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে কড়া চিঠি ও বিবৃতি দিয়েছে দেশটির ১২ জন কংগ্রেসম্যান। বিপরীতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে দফায় দফায় যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করা হয়।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলে দেশটির বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারসংক্রান্ত আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া, অর্থনৈতিকবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জোসে ডব্লিউ ফার্নান্দেজ এবং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংকট নিরসনে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনা করে মধ্যস্থতার চেষ্টা চালাবে এই টিম। ঢাকায় সফরটি শুরু হতে পারে ১০ জুলাই থেকে এবং প্রতিনিধি দলের সদস্যদের ১৩ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থানের কথা রয়েছে।
মার্কিন এ প্রতিনিধিদলের সফর নিয়ে জনমনে নানা কৌতূহল দেখা দিয়েছে। তবে অনেকের আগ্রহ ঘুরপাক খাচ্ছে ডোনাল্ড লুকে ঘিরে। কারণ পাকিস্তানে ইমরান খান সরকারকে অপসারণে ডোনাল্ড লুর নাম সবচেয়ে বেশি আলোচিত। পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সরকারকে হটানোর জন্য দেশটির ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সরাসরি মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুকে দায়ী করেন। সূত্র জানিয়েছে, এই কূটনীতিক ঢাকা সফরকালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে সমঝোতার পরামর্শ দিতে পারেন।
তবে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, রাজনৈতিক সমঝোতার নামে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিনিধিদলের সফর পরোক্ষভাবে সরকারের ওপর প্রবল স্নায়ুচাপ তৈরি করবে। বিশেষত, অতীতের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সমঝোতা উদ্যোগের এই আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি। মূলত সংকট নিরসনে এ আলোচনার উদ্যোগটি ভূ-রাজনৈতিক কৌশল ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়। কেননা যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ ও উদ্দেশ্য হাসিল করতে এভাবে সরকারের ওপর নানামুখী চাপ অব্যাহত রাখবে।