পেঁয়াজের দাম কেমন করে রাতারাতি দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল, সেই ব্যাখ্যা ব্যবসায়ীদের কাছে চেয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, আসন্ন রোজার মাসে বাজার দর যেন যৌক্তিক পর্যায়ে থাকে।
ব্যবসায়ীদের সতর্ক করে তিনি বলেছেন, নিজে ব্যবসায়ী বলে ‘ব্যবসায়ীদের প্রতি আনুকূল্য দেখানোর’ অভিযোগও তাকে শুনতে হয়েছে। সব মিলিয়ে তিনি এখন বসবাস করছেন ‘আগুনের মধ্যে’।
রোজা সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ, সরবরাহ, আমদানি, মূল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক এবং স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ী এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় বাণিজ্যমন্ত্রীর এমন মন্তব্য আসে।
ভারত সরকার গতবছর হঠাৎ করেই পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিলে প্রতিদিনের রান্নায় বহুল ব্যবহৃত এই সামগ্রীর দাম বাংলাদেশের বাজারে আড়াইশ টাকায় পৌঁছায়, যার নজির অতিতে আর নেই।
ওই পরিস্থিতিতে বাজার সামাল দিতে মাঠে নামে ভ্রাম্যমাণ আদালত। বার বার আশা দিয়েও দাম কমাতে না পারায় সমালোচিত হন বাণিজ্যমন্ত্রী।
সেই সময়ের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি মতবিনিময় সভায় ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, ১২ ঘণ্টার মধ্যে দামটা দ্বিগুণ করে ফেললেন কেন? ২৯ সেপ্টেম্বর তারিখ (ভারত রপ্তানি) বন্ধ করল, ৩০ তারিখ সকাল বেলা (দাম) দ্বিগুণ কেন হল? নৈতিকতার বিষয়টা এখানে আছে। আমার কাছে এ প্রশ্নের উত্তর নেই।”
সে সময় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযান কেন চালাতে হয়েছিল, সেই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, “যেখানে দ্বিগুণ লাভ করছেন সেখানে দরকার ভোক্তা (অধিকার অধিদপ্তরের অভিযান)। আমার কোনো দায় পড়ে নাই যে আপনাদের ওপর আঘাত হানব। আমাকে ব্লেইম করা হয়েছে- ‘আপনি ব্যবসায়ী বলে বেশি ফেভার করছেন ব্যবসায়ীদের, আপনি আরো শক্ত হতে পারতেন, কঠোর হতে পারতেন।’
“এ জায়গায় বসে আমি আগুনের মধ্যে বসবাস করছি ভাই, কথাটা বুঝতে পারছেন?”
ব্যবসায়ীদের ভবিষ্যতের বিষয়ে সতর্ক করে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, “রোজার মাসে যেন লজিক্যাল হই, রজমানে সহনীয় লাভ করবেন। আজ বাজার (দর) কী আছে এটা এক ঘণ্টার মধ্যে বের করা যায়। পরের স্টেপগুলোর দাম সবার সাথে আলোচনা করে আমরা বেঁধে দিতে চাই। রিটেইলে ১০ টাকা লাভে ছাড়তে বলেছেন, রাজি হয়ে গেছি, ২০ টাকা বেড়ে গেলে ভোক্তা (ভ্রাম্যমাণ আদালত) না পাঠিয়ে কী করব? বুঝতে পারছেন কথাটা ভাই?”
রোজার মাসে ২ লাখ টন অতিরিক্ত পেঁয়াজ প্রয়োজন হয় জানিয়ে টিপু মুনশি বলেন, “আমাদেরকে পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে । আমাদের কোনো পথ নেই। ভারত যদি ওপেন করে দেয়, আমরা ওয়ে-আউট করব যে আপনাদের কী পরিমাণ লোকসান হচ্ছে। একটাই দোহাই আপনাদের কাছে, রাতারাতি বড়লোক হওয়া যাবে না, রাতারাতি ভাগ্য পরিবর্তন করা যাবে না।”
“রমজান মাসটাকে স্পেলাশ কনসিডার করবেন, এটাই আমাদের আবেদন। পেঁয়াজ আমদানি করবই, পেঁয়াজের মাইর আমরা খাব না।”
বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকারের মধ্যেও যে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে, সে বিষয়টিও উঠে আসে এ সভার আলোচনায়।
“মন্ত্রণালয়ের তথ্য উপাত্তের সমন্বয় নেই। সঠিক তথ্য না পেলে কখনোই বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কৃষি থেকে চাহিদার কোনো ফিডব্যাক পাই না। চাহিদা ঠিক কত না জানালে, আমদানি হবে কীভাবে?”
সভায় উপস্থিত কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব তোফাজ্জেল হোসেন ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদনের কথা জানালেও মজুদের ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদও সভায় তথ্য-উপাত্তের বিষয়ে সমন্বয় করার তাগিদ দেন।
রোজার আগে ২ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি
সরকার ২০২০ সালের যে ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেছে, তাতে ২৫ এপ্রিল রোজা শুরু হবে ধরে নিয়ে ছুটি হিসাব করা হয়েছে।
রোজা শুরুর আগেই ৩১ মার্চের মধ্যে চার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দুই লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হবে বলে জানানো হয় সভায়।
এর মধ্যে সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ ও এস আলম গ্রুপের মাধ্যমে দেড় লাখ টন এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা টিসিবির মাধ্যমে ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করা হবে জানিয়ে তোফায়েল আহমেদ বলেন, “বড় গ্রুপের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি আমদানিকারকদের মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানিও অব্যাহত থাকবে। তাদের যদি কোনো সমস্যা হয়, তাদের সব ধরনের সহযোগিতা সরকার করবে।”
বাজারে গুজব রটিয়ে কেউ যাতে আতঙ্ক ছড়াতে না পারে, সে বিষয়ে সজাগ থাকার আহ্বান জানান তোফায়েল আহমেদ।
তিনি বলেন, “মানুষকে শান্তি ও স্বস্তিতে রাখতে হবে। ব্যবসায়ীদের সাথে জোড়াজুড়ি করে, আদৌ কোনো লাভ হবে না। লাভ করুক, তবে সেটা হতে হবে সহনীয় মাত্রায়। ”
শ্যামবাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী হাজী মো. মাজেদ বলেন, “ভবিষ্যতে আবারও সর্তক হওয়ার প্রয়োজন আছে। গত এক সপ্তাহে পেঁয়াজের ঘাটতির জন্য ৩৫ থেকে ৪০ টাকা দাম বেড়ে গেছে। বৃষ্টি হলেই পেঁয়াজ নিয়ে বেশি সমস্যা তৈরি হয়।”
ঢাকার মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা বলেন, “চিনি ও ভোজ্য তেলে ভ্যাট ট্যাক্স কমিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। আদা, রসুন, ডাল, চিনির কোনো ঘাটতি নেই। তবে ডলারের দাম বেড়ে যাবে। ভোক্তাদের কম দামে পণ্য দিতে হবে, আবার ভ্যাট ট্যাক্সও বেশি দিতে হবে- এ ত্রিমুখী নীতি থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে।”