পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের শাহ আমানত ট্রেডার্স। এর মালিক তৈয়ব আলী কারসাজি করে কয়েকগুণ বেশি দামে আদা বিক্রি করেছেন- এ প্রমাণ পান জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। আদা বিক্রির কোনো কাগজ দেখাতে পারেননি তিনি। আমদানির কাগজ ঘেঁটে দেখা যায় মিয়ানমার থেকে প্রতিকেজি ৮৪ টাকায় কেনা হয়েছে আদা। কারসাজি করে সেই আদা ২৩০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। কত টাকায় পণ্য আমদানি ও কত টাকায় বিক্রি হচ্ছে- এসব তথ্য গোপন করে সাধারণ ক্রেতাদের পকেট কাটতে অভিনব কৌশল নিয়েছেন তৈয়ব আলীর মতো খাতুনগঞ্জের অনেক ব্যবসায়ী। আদা কার কাছে বিক্রি করা হচ্ছে সে তথ্যও গোপন রাখছেন তারা। এভাবে ‘পেপারলেস ব্ল্যাকমার্কেট’ তৈরি করেছেন তারা।
বিক্রির কাগজপত্র সংরক্ষণ না করে শুধু টেলিফোনে যোগাযোগ করে আমদানিকারকরা পণ্যের দাম ঠিক করে দিচ্ছেন পাইকার বা কমিশন এজেন্টদের। আমদানিকারকরা কমিশন এজেন্ট ও দালালদের মাধ্যমে সরাসরি বন্দর থেকে আড়তদারদের কাছে পণ্য পৌঁছে দিচ্ছেন। কেউ কাউকে দিচ্ছেন না ক্রয়-বিক্রয়ের রসিদ। ভ্রাম্যমাণ আদালতকে ফাঁকি দিয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে এমন অভিনব পন্থা বেছে নিয়েছেন অনেক অসাধু ব্যবসায়ী। কোনো কাগজ না থাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে পড়ছেন বিড়ম্বনায়। জেলা প্রশাসন ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাস রোধে আদা চায়ের উপকারিতা নিয়ে প্রচার থাকায় কারসাজিতে মেতে ওঠে চট্টগ্রামভিত্তিক ৩২ জনের একটি সিন্ডিকেট।
সিন্ডিকেটের সঙ্গে আছে আমদানিকারক, ব্রোকার, কমিশন এজেন্ট ও আড়তদাররা। কারসাজি করে চার দফায় দাম বাড়িয়ে প্রতিকেজি ৮০ টাকার আদা ৩৬০ টাকায় নিয়ে যায় তারা। গত ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত ৩২ আমদানিকারক ৩৫টি চালানে তিন হাজার ১৪৪ টন আদা আমদানি করেছেন। খাতুনগঞ্জের একেক আড়তদার কয়েক টন করে আদা কিনলেও কোনো রসিদ নেই তাদের কাছে। আবার কয়েকগুণ বেশি দামে আদা বিক্রির রসিদ রাখছেন না তারা।
বেশকিছু আড়তে অভিযান চালিয়ে কাগজপত্রহীন ব্যবসার প্রমাণ পেয়েছে জেলা প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থা। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘কারসাজি করে কয়েকগুণ বেশি দামে আদা বিক্রি করতে পেপারলেস ব্ল্যাকমার্কেট তৈরি করেছে অনেকে। মূলত আমদানি করা আদা কত টাকায় কিনে তা কত বাড়তি টাকায় বিক্রি হচ্ছে- এ তথ্য গোপন রাখতেই অভিনব
কৌশল নিয়েছে তারা। আমদানির কাগজপত্র ঘেঁটে কয়েকগুণ বাড়তি দামে পণ্য বিক্রির প্রমাণ মিলছে। এতে জড়িতদের চিহ্নিত করছি। এদের তালিকা তৈরি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হবে।’
প্রশাসনের চোখে ধুলা দিতে খাতুনগঞ্জের অনেক ব্যবসায়ী পান-সুপারি, বার্মিজ প্রসাধনী কিংবা অন্য কোনো পণ্যের পসরা নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে রেখেছেন। অথচ এর আড়ালেই তারা অন্য কাঁচাপণ্যের ব্যবসা করছেন। সোমবার খাতুনগঞ্জের একটি পান-সুপারির গোডাউনে লুকিয়ে রাখা ১২ টন আদা উদ্ধার করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। ৮৮ বস্তায় রাখা আদা বেশি দামে বিক্রির জন্য গোপনে মজুদ করেন ব্যবসায়ী। পরে বিষয়টি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারও করেন। নগরের রিয়াজউ?দ্দিন বাজা?রের পদ্মা বাণিজ্যালয়ে প্রতিকেজি ১৮০ টাকায় কেনা আদা ২৮০ টাকায় বিক্রির প্রমাণ পায় জাতীয় ভোক্তা অ?ধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। গতকাল অভিযান চালিয়ে এ প্রমাণ পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটিকে ৪০ হাজার টাকা জ?রিমানা করা হয়। অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলা কার্যাল?য়ের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, ক্রয়মূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে আদা বিক্রি করলেও এর কোনো রসিদ দেখাতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
এর আগে খাতুনগঞ্জের মাহবুব খান সওদাগর, একতা ট্রেডার্স, শাহাদাত ট্রেডার্সসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে প্রতিকেজি ৮০ থেকে ৯০ টাকার আদা ২৩০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রির প্রমাণ পাওয়া গেলেও কারও কাছে রসিদ পাওয়া যায়নি। এক ব্যবসায়ী সমকালকে বলেন, ‘আমদানি করা পণ্য ক্রয়মূল্যের চেয়ে অনেকগুণ বেশি দামে বিক্রি করা হয়। রসিদ সংরক্ষণ করলে মোটা অঙ্কের জরিমানা গুনতে হবে। তাই এখন মুঠোফোনে কথা বলেই পণ্যের দরদাম ঠিক করা হয়। এমন পদ্ধতিতে সহজে কয়েকগুণ বেশি লাভ করা যায়।’ ক্যাবের কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীদের এই অভিনব পন্থায় জড়িতদের দ্রুত চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।