আদিলুরের রায়: দুই বছরের কারাদণ্ড

1694703123.83_n

এক দশক আগে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অভিযোগে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে হওয়া মামলায় মানবাধিকার সংগঠন অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও সংস্থাটির পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানকে দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল।

বৃহস্পতিবার (১৪) রায় পর্যবেক্ষণের জন্য বেশ কয়েকটি দূতাবাসের প্রতিনিধি, মানবাধিকার কর্মীসহ বিশিষ্টজনরা আদালতে হাজির হন।

রায়ের পর তাদের মধ্যে কেউ কেউ উদ্বেগও প্রকাশ করেন।

দুপুর ২টার দিকে রায় ঘোষণার জন্য আগেই সময় নির্ধারিত ছিল। বেলা পৌনে ২টায় দুই আসামি অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলান তাদের আইনজীবীসহ আদালতে আসেন।

তার কিছুক্ষণ আগে আদালত এলাকায় আসেন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা অস্ট্রেলিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের দূতাবাসের প্রতিনিধি।

এ সময় তারা একত্রে এজলাসে প্রবেশ করেন। দুপুর ২টা ১০ মিনিটে বিচারক রায় পড়া শুরু করেন। ইংরেজিতে লেখা ৫০ পৃষ্ঠার মূল রায়ের সারাংশ পড়ে শুনান ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ এম জুলফিকার হায়াত। দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতিতে প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে তিনি রায় পড়েন। এরপর আসামিদের দণ্ড ঘোষণা করেন৷ বিলুপ্ত তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় তাদের দোষী সাব্যস্ত করে দুই বছরের কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক মাসের সাজা দেওয়া হয়।

যদিও ৫৭(২) ধারা মোতাবেক তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের সর্বোচ্চ ১৪ বছর ও সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদণ্ড ছিল। তবে পুরো বিচারকাজে উপস্থিত থাকা ও সহায়তা করায় তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত।

আদালতের এ রায়ে রাষ্ট্র বা আসামিপক্ষের কেউ সন্তুষ্ট নয়। দোষী প্রমাণিত হওয়ার পরও এত কম সাজা দেওয়ায় রায় পর্যালোচনা আপিলের কথা জানান ওই আদালতের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর নজরুল ইসলাম শামীম।
অপরদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ রুহুল আমিন ভুঁইয়াও আপিল করবেন বলে জানান।

রায় শেষে জামিন বাতিল করে তাদের সাজা পরোয়ানাসহ কারাগারে পাঠানো হয়। পুলিশ বেষ্টনিতে যাওয়ার সময় আদিলুর সাংবাদিকদের বলেন, ন্যায়বিচার পাইনি, আপিল করব। পরে প্রিজনভ্যানে উঠানোর সময় পুলিশের সঙ্গে আদিলুরের কিছুটা বাগবিতণ্ডা হয়। হাত উঠিয়ে আদিলুর প্রতিবাদ করতে গেলে কয়েকজন পুলিশ তার হাত নামিয়ে দেন।

এ সময় উপস্থিত মানবাধিকার কর্মী ও বিশিষ্টজনরা পুলিশের এ আচরণের প্রতিবাদ জানান।

রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন, জাতিসংঘের ঢাকা অফিসের সিনিয়র মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খান, ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার, মানবাধিকার কর্মী ইজাজুর রহমান, আদিলুরের বোন তাসকিন রহমান, গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সংগঠন মায়ের ডাকের সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম, ঢাকাস্থ অস্ট্রেলিয়ান অ্যাম্বাসির ফাস্ট সেক্রেটারি সাচা ব্লুমেনসহ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডিয়ান দূতাবাসের প্রতিনিধিরা।

রায়ের পর বিদেশে পর্যবেক্ষকরা কোনো মন্তব্য করেননি। তবে রায়ের প্রতিক্রিয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন মানবাধিকার কর্মী ও বিশিষ্টজনরা।

রায়ের পর মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন সাংবাদিকদের বলেন, একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে যে আইনটির বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করেছি, সেই আইনেই একজন মানবাধিকার কর্মীকে সাজা দেওয়া হলো, এটি আইন ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। স্বাভাবিকভাবে একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে আমরা উদ্বিগ্ন ও হতাশ।

রায়ের পর ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সিআর আবরার সাংবাদিকদের বলেন, নাগরিকদের ওপর যে চাপ এবং নাগরিকদের যে ভালনারেবল করে রাখা এবং সে যেন স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে না পারে, স্বাধীনভাবে তাদের কথাবার্তা বলতে না পারে, সেটি কিন্তু মোটামুটিভাবে আবার প্রতিষ্ঠিত হলো। আমরা গণতন্ত্রের কথা বলছি, আমার মনে হয় আমরা সেখান থেকে অনেক বেশি পিছিয়ে যাচ্ছি।

এ মামলায় গত ২৪ আগস্ট রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়। ওইদিনই আদালত রায়ের জন্য ৭ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেছিলেন। তবে ওইদিন রায় প্রস্তুত না হওয়ায় রায়ের জন্য ১৪ সেপ্টেম্বর নতুন দিন ধার্য করা হয়।

মামলার বিবরণীতে জানা যায়, ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে ৬১ জনের মৃত্যু হয়েছে মর্মে প্রতিবেদন প্রকাশ করে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার।

ওই বছরের ১০ জুলাই নিহতের তালিকা চেয়ে অধিকারকে চিঠি দেয় তথ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু সংগঠনটি তালিকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে একই বছর ১০ আগস্ট গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন ডিবির উপ-পরিদর্শক আশরাফুল ইসলাম। ওইদিনই গ্রেপ্তার হন অধিকার সম্পাদক। পরে ওই বছরের ৯ অক্টোবর হাইকোর্ট থেকে জামিন পান আদিলুর।

তদন্ত শেষে ২০১৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ২৮ জনকে সাক্ষী করে আদিলুর ও এলানের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। ওই বছর ১১ সেপ্টেম্বর অভিযোগপত্র আমলে পলাতক আসামি এলানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। এলানও ওই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর আত্মসমর্পণ করে কারাগারে যান। এরপর হাইকোর্ট থেকে জামিন পান।

২০১৪ সালের ৮ জানুয়ারি মামলাটিতে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচারকাজ শুরু হয়। অভিযোগ গঠন সংক্রান্ত আদেশের পর উচ্চ আদালতে মামলা বাতিল চাইলে উচ্চ আদালতের আদেশে বিচারকাজ স্থগিত হয়ে যায়। হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের পর ২০২১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সেই মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। সাক্ষ্যগ্রহণকালে আদালত মামলাটি পুনঃতদন্তের আদেশ দেন। এরপর তাদের বিরুদ্ধে একটি সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। বিচার চলাকালে আদালত মোট ২২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন।

Pin It