যে কোনো বড় আলোড়নের আগে তা গুমরাতে থাকে। বড় কোনো ভূমিকম্পের আগে ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়। তেমনি কোনো একটি বড় তোলপাড় যখন ইতিহাসের গর্ভে গুমরাতে থাকে, ছোট ছোট আন্দোলনের দোলা সেটির উদ্গীরণ ঘটাতে এগিয়ে আসে। ভাষা আন্দোলনও ’৪৭ থেকে শুরু হয়ে ১৯৫২ সালে এসে প্রচণ্ড তীব্রতায় জ্বলে ওঠার প্রতীক্ষায় ছিল।
১৯৫২ সালের ২৪ থেকে ২৬ জানুয়ারি ঢাকায় ছিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের কাউন্সিল। প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় এসেছিলেন সেই কাউন্সিল উপলক্ষ্যে। ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় পাকিস্তানের গুণকীর্তন ও সরকার পূর্ব বাংলার জন্য কী কী করেছে তা উল্লেখ করে বক্তৃতা করেন তিনি। শেষ পর্যায়ে তিনি ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তানকে আমরা ইসলামি রাষ্ট্ররূপে গঠন করতে যাচ্ছি।’ কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দোহাই দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রদেশের ভাষা কী হবে তা প্রদেশবাসীই স্থির করবেন, কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। একাধিক রাষ্ট্রভাষা থাকলে কোনো রাষ্ট্র শক্তিশালী হতে পারে না।’ তিনি বলেন, ‘পরীক্ষামূলকভাবে একুশটি কেন্দ্রে বাংলাভাষাকে আরবি হরফে লেখার প্রশিক্ষণ সফল হয়েছে এবং জনগণ নিজ উদ্যোগে নতুন কেন্দ্র খুলছে।’
খাজা নাজিমুদ্দিনের এই মন্তব্যটুকুই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের দাবানল সৃষ্টির পক্ষে যথেষ্ট ছিল। এ প্রসঙ্গে ভাষা আন্দোলনের সময়ের অন্যতম নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা বলেছিলেন, ‘নাজিমুদ্দিন সাহেব ভাষার প্রশ্নে ঐ ধরনের বিবৃতি না দিলে বোধহয় ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা না-ও ঘটতে পারত। নাজিমুদ্দিনের এই বক্তৃতার জন্য ভাষা আন্দোলন দ্রুত এগিয়ে গেছে।’ নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতা রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচার হয়েছিল। ফলে সারা পূর্ববঙ্গেই এর তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল।
নাজিমুদ্দিনের এ ঘোষণা প্রসঙ্গে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান মন্তব্য করেছিলেন, “নাজিমুদ্দিন সাহেব যেদিন ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’, তার পরের দিনই আমরা পুরোনো আর্টস বিল্ডিংয়ের আমতলায় তড়িঘড়ি সভা করে এর নিন্দা জানাই।” হাবিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমাদের ওপর একটা সবক চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, জিন্নাহর কথাই অভ্রান্ত। এর নড়চড় হবে না।’ সেদিন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান জিন্নাহ সাহেবকে কায়েদে আজম হিসেবে সম্বোধন না করায় বৈঠকে দু-এক জন ছাত্র মারমুখো হয়ে উঠেছিল।
নাজিমুদ্দিনের এ বক্তৃতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং ঢাকার অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও ধর্মঘটের আহ্বান করা হয়। এছাড়া সেদিনের সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে ছাত্র ধর্মঘটের আহ্বান জানানো হয়।
৪ ফেব্রুয়ারির সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে প্রথম পৃষ্ঠা জুড়ে ৩০ জানুয়ারির বিক্ষোভের বিবরণ ছিল। রিপোর্টের শিরোনামগুলো দেওয়া হয় এভাবে—‘নাজিমুদ্দিনের বিশ্বাসভঙ্গে বিক্ষোভের বিসুবিয়াস পূর্ববঙ্গ’, ‘রক্তের স্বাক্ষরে জঙ্গী জনতার শপথ’, ‘উর্দু নয়—বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করিতে হইবে’, ‘শোভাযাত্রা সংগঠনে রূপান্তরিত হইয়াছে’, ‘১৯৪৮ সালের পথই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রামের পথ’।
এদিকে ৩১ জানুয়ারি বিকেলে ঢাকার বার লাইব্রেরিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়। এখানে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন কাজী গোলাম মাহবুব। আর আব্দুল মতিন (ভাষা মতিন) ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক। সভায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের দুজন করে প্রতিনিধি এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিটি হল থেকে দুজন করে প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এতে ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট করার সিদ্দান্ত গৃহীত হয়।
৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা শহরের সব স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী উর্দুকে পাকিস্তানে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা এবং আরবি হরফে বাংলা ভাষার প্রচলনের চেষ্টার প্রতিবাদে ধর্মঘট পালন করে। বেলা ১১টা থেকেই শিক্ষার্থীরা মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত হতে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন গাজীউল হক। সভা শেষে প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী মিছিল করেন।
এদিনের এই ধর্মঘট ও বিক্ষোভ নিয়ে ‘সাপ্তাহিক ইত্তেফাক’-এ বেশ অনেকগুলো রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সেসব রিপোর্টের কিছু কিছু অংশ দেওয়া হলো :৪ঠা ফেব্রুয়ারি হরতাল! হরতাল! সাধারণ হরতাল! সাধারণ ছাত্র হরতাল! সর্বত্র প্রস্তুতি। রাস্তায়, অলিতেগলিতে, বস্তিতে পোস্টার আর প্রচার। কোথাও বাধা নেই। এখানে সহানুভূতি, সমর্থন, সক্রিয় কর্ম্মপ্রচেষ্টা। ১৯৪৮ সাল হইতে ১৯৫২ সাল পর্য্যন্ত সময়ের রূঢ় বাস্তবতা কল্পনাপ্রবণ চিন্তাধারাকে বিনাশ করিয়া আজ দেশবাসীকে বর্ণভাষা, শিক্ষা-সংস্কৃতির পথে ঐক্যবদ্ধ করিয়া তুলিয়াছে।
শিক্ষার্থীদের সেই মিছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় এসে শেষ হয়। সেখানে প্রদেশব্যাপী ২১ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘটকে সফল করার আহ্বান জানানো হয়। দেখা যাচ্ছে, ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতা ছিল একটি স্ফুলিঙ্গ, যা ৪ ফেব্রুয়ারি একটি দাবানলের মুখে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো বিস্ফোরিত হয়েছিল। আর তা প্রচণ্ড রূপ ধারণ করেছিল ২১ ফেব্রুয়ারিতে।