ষোল বছর আগে ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের যে সমাবেশে বর্বর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল, সেই সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি সমাবেশে যোগ দিতে চেয়েছিলেন জাতির জনকের ছোট মেয়ে শেখ রেহানাও, কিন্তু বড় বোন শেখ হাসিনা সেদিন তাকে বাসাতেই রেখে যান।
আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তি জীবনের অজানা-অদেখা গল্প নিয়ে নির্মিত ‘হাসিনা: আ ডটার’স টেল’ প্রামাণ্যচিত্রে সেই দিনটির কথা স্মরণ করেছেন শেখ রেহানা।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গ্রেনেড হামলার পর ধানমণ্ডির সুধা সদনে বসে তিনি নানা খারাপ খবর পাচ্ছিলেন। এর মধ্যে বড় বোন শেখ হাসিনা যখন প্রাণে বেঁচে ফিরলেন, তাতেই তিনি যেন সব ফিরে পেয়েছিলেন।
“তখন জিজ্ঞাসাও করি নাই কী হচ্ছে বা কী হলো… আপাকে পেয়ে আমি ব্যাস, আর কিছু…’
সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে যোগ দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই সেদিন ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসের শিকার হন; আর সেই হামলার মূল লক্ষ্য ছিলেন দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন সপরিবারে হত্যা করা হল, বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে দলের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে দলকে ফেরান ক্ষমতায়। এরপর ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে এবং তার তিন বছরের মাথায় শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ওই গ্রেনেড হামলা হয়।
দলের অনেক কর্মসূচিতে শেখ হাসিনার পাশে শেখ রেহানাকে নিয়মিতভাবে দেখা গেলেও ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট ছোট বোনকে বাসায় রেখেই বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সেই সমাবেশে যোগ দিতে গিয়েছিলেন তখনকার বিরোধী দলীয় নেতা হাসিনা।
( গ্রেনেড হামলার আগে শেখ হাসিনার ভাষণ )
প্রামাণ্যচিত্রে শেখ রেহানা বলেন, “আমি খুব অনুরোধ করলাম আপাকে, আপা আমি যাই তোমার সাথে আজকে। তো উনি বললেন, ‘না, তুমি বাসায় থাকো, তোমার যেতে হবে না’।“না আমি যাই তোমার সাথে, আজকে যাব আমি। (আপা বললেন) ‘না তুমি যাবা না’। আমি তখন অভিমান করে, খুব রাগ… ছোটবেলার মতই ধামধুম করে ঘরের ভিতর চলে গেলাম।”
এর মধ্যে বাসায় কয়েকজন মেহমান যায় জানিয়ে শেখ রেহানা বলেন, “আপা বললেন, ‘উনাদের তুমি চা-নাস্তা খাওয়াও, গল্প করো, আমি এখনই আসব’।”
মেহমানদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে হামলার খবর পান শেখ রেহানা।
“ওই ঘটনা দেখে আমি (বাসার) নিচে চলে আসছি। ওর মধ্যে খবর আসছে যে (শেখ হাসিনা) নাই।”
বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে সেদিন সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি শোভাযাত্রা হওয়ার কথা ছিল। তার আগে রাস্তায় ট্রাকের ওপর অস্থায়ী মঞ্চ করে চলছিল সমাবেশ। তখনকার বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা তার বক্তব্য শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণ।
সেদিনের হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ অগাস্ট মারা যান। প্রায় দেড় বছর পর মৃত্যু হয় ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের। পরে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে।
আকস্মিক সেই হামলার মুখে প্রাণ তুচ্ছ করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও নিরাপত্তাকর্মীরা সেদিন মানবঢাল তৈরি করেছিলেন, সেই দুঃসাহসিক চেষ্টায় সেদিন বেঁচে যায় বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রাণ। পরে গাড়িতে করে তাকে যখন বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে সুধা সদনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখনও গুলি ও গ্রেনেড ছোড়া হয়।
শেখ রেহানা বলেন, “এর মধ্যে আপার গাড়িটা (সুধা সদনে) এলো, এসে দাঁড়ালো। আমি সেখানে দাঁড়ানো। দেখলাম, আপার সমস্ত শরীরে, শাড়িতে, মুখেচোখে রক্ত ভরা। আমি আস্তে আমার আঁচলটা দিয়ে আপার এগুলো মুছে আপাকে ধরে ভেতরে আনলাম।”
( শেখ হাসিনার বক্তৃতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় গ্রেনেড হামলা )
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের ওই গ্রেনেড হামলা ছিল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত।২১ অগাস্টের ওই ঘটনার পাশাপাশি শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন ঘটনা উঠে এসেছে প্রামাণ্যচিত্র ‘হাসিনা: আ ডটার’স টেল’ এ।
১৯৫২ সালে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকায় আসা, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে দেশে ফেরা, দিক হারানো আওয়ামী লীগের হাল ধরে দলকে আবার কক্ষপথে ফেরানো, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রিত্ব- সব বিষয়ই প্রামাণ্যচিত্রে তুলে এনেছেন নির্মাতা।
শেখ হাসিনাকে নিয়ে নির্মিত এই প্রামাণ্যচিত্রে খুব স্বাভাবিকভাবেই উঠে এসেছে বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার সম্পর্ক, তার সংস্পর্শে বেড়ে ওঠা, বাবার রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি তার অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসের বিষয়টি।
শোকের মাস উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশন ছাড়াও আটটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে এ প্রামাণ্যচিত্রটি প্রচার করা হয়।