ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদের মৃত্যুতে বিশ্বের নানাপ্রান্তের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা শোক প্রকাশ করছেন, যাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম, মেলিন্ডা গেটস এবং অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী অভিজিৎ ব্যানার্জি ও এস্তার দুফলো রয়েছেন।
দুর্গতদের সহায়তার পাশাপাশি দরিদ্রের জীবনমানের উন্নয়নে কয়েক দশক কর্মতৎপরতা চালিয়ে আসা ফজলে হাসান আবেদ ৮৩ বছর বয়সে শুক্রবার ঢাকার একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
তার মৃত্যুর খবর প্রকাশের পরপরই শোক বার্তা পাঠান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার দেশ-বিদেশের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এই তালিকায় যুক্ত হয়েছেন।
( যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে ফজলে হাসান আবেদ )
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন শোক বার্তায় বলেছেন, “স্যার ফজল আবেদের জীবন মানবতার জন্য এক বিরাট উপহার। প্রায় ৫০ বছর ব্র্যাকে তার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব বাংলাদেশ ও তার বাইরে কোটি মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে।”ফজলে হাসান আবেদের এই কর্মযজ্ঞ উন্নয়ন সম্পর্কে বিশ্বের ভাবনাকে বদলে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
বিল ক্লিনটন বলেন, ফজলে হাসান আবেদ সব স্তরের মানুষের সহজাত মর্যাদার প্রতি অবিচল থেকে কাজের মাধ্যমে অতি দরিদ্রদের নিজের ও পরিবারের দিন বদলে সক্ষম করে তুলেছেন।
“প্রেসিডেন্ট থাকাকালে বাংলাদেশে মানুষের জীবন বদলে তার কার্যক্রম স্বচোখে দেখা, অনেক বছর ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের সঙ্গে তার কাজ করা এবং হিলারি ও আমার প্রতি তিনি যে আন্তরিকতা, বন্ধুত্ব ও অনুপ্রেরণা দিয়েছেন সেজন্য আমি সব সময় কৃতজ্ঞ থাকব।”
ফজলে হাসান আবেদ: মানুষের জন্য এক জীবন
ফজলে হাসান আবেদের কাজের জন্য যাদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেছে তাদের কাছে তিনি চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন বলেও মন্তব্য করেছেন বিল ক্লিনটন।এ বছর অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী অভিজিৎ ব্যানার্জি ও তার স্ত্রী এস্তার দুফলো এক শোক বার্তায় বলেছেন, “ফজলে হাসান আবেদের মতো মানুষ আমরা কয়টা দেখি? তার অনুপস্থিতি আমাদের সবার মধ্যে বড় কিছু হারানোর অনুভূতি এনে দিয়েছে।”
আবেদের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বলেছেন, “তার কর্মের বিপুল বিস্তৃতি ও প্রভাব এবং যে পরিপূর্ণ বিনয় সহকারে কাজগুলো তিনি সম্পন্ন করেছেন, উভয়ই আমাদের শিক্ষার নিবিড় পাথেয় হয়ে থাকবে।”
বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মেলিন্ডা গেটস বলেছেন, “১৯৭২ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে প্রত্যাগত শরণার্থীদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য ১০ হাজার ৪০০ ঘর নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত আরও অর্থ সংগ্রহ করে তিনি ১৬ হাজার ঘর করেছিলেন। তারপরও কিছু অর্থ উদ্বৃত্ত থেকে গিয়েছিল, যা দিয়ে পরের প্রকল্প শুরু করেছিলেন। এমনই এক মহৎ মানবতাবাদী ছিলেন তিনি।
স্যার ফজলে হাসান আবেদের চিরপ্রস্থান
“তিনি আমাদের দেখিয়েছেন সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রয়োজনকে বিস্মৃত না হয়ে কীভাবে বৃহৎ ও কার্যকর সংগঠন গড়ে তুলতে হয়। তার কাজ আমাদের চিরকালীন অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।”
‘যেতে হবে আরও বহু দূর’
ফজলে হাসান আবেদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ব্র্যাক বাংলাদেশের চেয়ারপারসন হোসেন জিল্লুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, “স্যার ফজলে হাসান আবেদ অসাধারণ দায়িত্ববোধ, সহমর্মিতার গভীর জীবনদর্শন ও নিরলস শ্রমের এক অবিস্মরণীয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষটারও ভাগ্য পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকে, এই বিশ্বাসে ভর করেই তিনি সফলভাবে গড়েছেন বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক। বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে আজ যা সারা বিশ্বে সমাদৃত। কিন্তু এই সাহস, এই আকাঙ্ক্ষা একেবারেই শেকড় থেকে আসা।
“চলে যাওয়ার বেদনার এই মুহূর্তেও পরপার থেকে তার স্মিত হাসি তাই ভরসা দিচ্ছে সহমর্মিতা, দায়িত্ববোধ ও শ্রম আঁকড়ে ধরে আরও বহু দূর যাওয়া যাবে, যেতে হবে। কারণ পৃথিবীতে ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের সংখ্যা এখনও অগণিত। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বিদায়।”দেশ-বিদেশ থেকে আরও শোকবার্তা পাঠিয়েছেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমদ ও আতিউর রহমান, ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর, ইউনিসেফের বাংলাদেশ প্রতিনিধি তোমু হোজুমি, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অশোকা-র প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিল ড্রেইটন, পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত কলামনিস্ট নিকোলাস ক্রিস্টফ, যুক্তরাজ্য সরকারের বৈদেশিক সহায়তা বিভাগ (ডিএফআইডি), অস্ট্রেলিয়া সরকারের বৈদেশিক সম্পর্ক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় (ডিএফএটি), সেভ দ্য চিলড্রেন, ইউকে-র প্রধান নির্বাহী কেভিন ওয়াটকিনস, বিওপি হাব, ওয়ার্ল্ড টয়লেট অর্গানাইজেশনের প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক সিম, যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকর্মী সাইদা রশীদ, টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদুল ইসলাম, ব্রিটিশ রেড ক্রসের সোফেনা লালানি, ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির গবেষক জিবাহ নোয়াকো, সাজিদা ফাউন্ডেশন, জাগো ফাউন্ডেশন, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সাহুল আফজাল চৌধুরী, ড. চঞ্চল খান, কামরুল মুরাদ প্রমুখ।
রোববার আর্মি স্টেডিয়ামে জানাজা, বনানীতে দাফন
ব্র্যাকের উদ্যোগে পরিচালিত স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ফজলে হাসান আবেদ।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ ও ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক মুহাম্মাদ মুসা জানান, রোববার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ফজলে হাসান আবেদের মরদেহ ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হবে। দুপুর সাড়ে ১২টায় সেখানেই জানাজা হবে। পরে বনানী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।ফজলে হাসান আবেদের স্মরণে রোববার বেলা ২টা থেকে মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টারে একটি শোকবই খোলা হবে। এছাড়া আড়ং, ব্র্যাক ব্যাংক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আগামী সোমবার এবং সারা দেশে ব্র্যাকের আঞ্চলিক অফিসগুলোতে আগামী মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত শোকবই থাকবে। শোকবই থাকবে ৩০ জানুয়ারি বিকাল ৫টা পর্যন্ত।