আমদানি-কারকদের একমাত্র ভরসা আগাম ডলার

image-718399-1694796795

বাজারে আগাম বা ফরোয়ার্ড ডলার বেচাকেনায়ও দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে। বিভিন্ন মেয়াদে আগাম ডলার এখন বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা ৬৪ পয়সা থেকে ১১৩ টাকা ৮৫ পয়সা। কোনো কোনো ব্যাংকে ১১৪ টাকা করেও বিক্রি হচ্ছে। বিশেষ করে বাণিজ্যিক আমদানির দেনা ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যাংকগুলো আগাম ডলার কিনে রাখে।

বাণিজ্যিক পণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি আমদানিতেও এখন একমাত্র ভরসা আগাম কেনা ডলার। এর বেশিরভাগই ব্যবহৃত হয় আমদানির দেনা পরিশোধে। এতে আমদানি পণ্যের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বাজারে এসব পণ্যের দামও বাড়ছে। অন্যান্য পণ্যের দামেও এর প্রভাব পড়ছে। এতে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়ছে।

বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ ১১০ টাকা দামেও ব্যাংকে আমদানির ডলার মিলছে না। এমনকি আন্তঃব্যাংকেও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়েই চড়া দামে এক মাস থেকে এক বছরের আগাম ডলার কিনে রাখতে হচ্ছে।

গত ৩ আগস্ট থেকে ডলারের নতুন বাড়তি দর কার্যকর হয়েছে। ওইদিন থেকে আমদানিতে প্রতি ডলারের দাম সর্বোচ্চ ১১০ টাকা বেঁধে দেওয়া হয়। নতুন দর কার্যকর হওয়ার দুই দিনের মধ্যেই এর দর সর্বোচ্চ পর্যায়ে অর্থাৎ ১১০ টাকায় ওঠে। আগে মাসের শেষদিকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠত।

ব্যাংকগুলোর আমদানি ও বৈদেশিক ঋণের দায় মিটিয়ে অতিরিক্ত ডলার থাকলে সেগুলো আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে বিক্রি করতে পারে। এখানেও সর্বোচ্চ ১১০ টাকা দামে বিক্রি করতে হবে। এর বেশি দামে বিক্রি করা যাবে না। তবে ব্যাংকগুলো ডলার বেচাকেনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ এক টাকা মুনাফা করতে পারবে। কিন্তু সব ব্যাংকই এখন সর্বোচ্চ দামে ডলার কিনছে। অর্থাৎ রপ্তানি বিল ও রেমিট্যান্স কিনছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা দামে। বিক্রি করছে ১১০ টাকা দামে। মুনাফা থাকছে ৫০ পয়সা। কিন্তু এর সঙ্গে পরিচালন ব্যয় রয়েছে। ফলে ডলার বেচাকেনা থেকে এখন মুনাফা অনেক কমে গেছে। এ কারণে আন্তঃব্যাংকে দাম কম হওয়ায় ব্যাংকগুলো এখানে ডলার বিক্রি করছে না। যেসব ব্যাংকের কাছে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত কিছু ডলার থাকছে সেগুলো তারা বেশি দামে আগাম বা ফরোয়ার্ড বিক্রি করছে। কারণ ওখানে ডলার বেশি দামে বিক্রি করা যাচ্ছে। এছাড়া প্রতি মাসেই যেহেতু ডলারের দাম ৫০ পয়সা থেকে এক টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে, এ কারণে আগাম বাজারে একটু বেশি দামে ডলার বিক্রি হচ্ছে।

বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) বৈঠকের মাধ্যমে প্রতিমাসেই আগে গড়ে এক টাকা করে বাড়ানো হতো। এখন বাড়ছে ৫০ পয়সা থেকে এক টাকা। ফলে ব্যাংকারদের মধ্যে একটি প্রত্যাশার জন্ম নিয়েছে, কিছু ডলার অতিরিক্ত সময় ধরে রাখলে মাস অতিক্রম করলেই ৫০ পয়সা থেকে এক টাকা বাড়তি মুনাফা পাওয়া যাবে। এ কারণে কিছু ব্যাংক বা গ্রাহক ডলার ধরে রাখছে।

তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো রপ্তানিকারকের ব্যাক টু ব্যাক এলসিসহ অন্যান্য দায় মিটিয়ে হিসাবে যদি অতিরিক্ত ডলার থাকে তবে সেগুলো ৩০ দিনের মধ্যে ব্যবহার করতে হবে। ৩০ দিন অতিক্রম করলে ব্যাংক ওই ডলার নিজ ক্ষমতাবলে নগদায়ন করে অন্য কাজে ব্যবহার করতে পারবে। ফলে এখন সর্বোচ্চ ৩০ দিনের বেশি ডলার ধরে রাখার সুযোগ নেই।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, প্রতিমাসে রপ্তানি আয় হচ্ছে গড়ে ৪৭০ থেকে ৪৮০ কোটি ডলার। এগুলোর প্রায় পুরোটাই লেগে যাচ্ছে রপ্তানিকারকদের। রপ্তানির বিপরীতে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ চলে যাচ্ছে ব্যাক টু ব্যাক এলসির দায় মেটাতে। বাকি যে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ থাকছে সেগুলো তারা গ্রুপের অন্য কোম্পানির আমদানিতে ব্যবহার করত। এখন একই ব্যাংকে হলে ব্যবহার করতে পারছে। কিন্তু অন্য ব্যাংকে হলে পারছে না। কারণ অন্য ব্যাংকে ডলার স্থানান্তর নিষিদ্ধ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে রপ্তানির ডলার এখন বাণিজ্যিক আমদানিকারকরা পাচ্ছে না। রেমিট্যান্স বাবদ প্রতিমাসে গড়ে ১৬০ থেকে ১৭০ কোটি ডলার আসছে। এর বেশিরভাগই ব্যবহৃত হচ্ছে সরকারি খাতের জ্বালানি তেল, গ্যাস, সার ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানিতে। ফলে বেসরকারি খাতের আমদানিকারকরা ডলার পাচ্ছেন না। তাদের যদি জরুরি কোনো পণ্য আমদানি করতে হয় তাহলে আগে ডলার বুকিং দিতে হয়। সেগুলো এক থেকে ছয় মাস মেয়াদি বা এক বছর মেয়াদিও হতে পারে। আগাম ডলার বুকিং দিয়ে সেই মেয়াদে এলসি খুলতে হবে। ফলে এখন আগাম ডলারের বাজার বেশ জমজমাট। মেয়াদ অনুযায়ী ডলারের দামও বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু টাকা দিতে হয় নগদ। অর্থাৎ এক মাস মেয়াদি আগাম কিনলে এখন টাকা দিয়ে এক মাস পর ডলার পাওয়া যাবে। এতে অনেক ব্যাংক শর্ত দিচ্ছে, যদি ডলার সরবরাহ করার সময় আগাম রেটের চেয়ে বেশি হয় তখন বাড়তি দামও দিতে হবে। আগাম ডলারও আছে হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংকের কাছে।

ব্যাংকগুলোতে আগস্টে এক মাস মেয়াদি আগাম ডলার বিক্রি হতো ১১০ টাকা ১৪ পয়সা দরে। এখন বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা ৬৪ পয়সা দরে। দাম বেড়েছে ৫০ পয়সা। দুই মাস মেয়াদি ডলার আগস্টে বিক্রি হতো ১১০ টাকা ৭৮ পয়সা দরে, এখন বিক্রি হচ্ছে ১১১ টাকা ২৮ পয়সায়। দাম বেড়েছে ৫০ পয়সা। তিন মাস মেয়াদি ডলার আগস্টে বিক্রি হতো ১১১ টাকা ৪২ পয়সা, এখন বিক্রি হচ্ছে ১১১ টাকা ৯৩ পয়সা দরে। দাম বেড়েছে ৫১ পয়সা। ছয় মাস মেয়াদি ডলার আগস্টে বিক্রি হতো ১১৩ টাকা ৩৪ পয়সা দরে। এখন বিক্রি হচ্ছে ১১৩ টাকা ৮৫ পয়সায়। দাম বেড়েছে ৫১ পয়সা। এক বছর মেয়াদি ডলার সর্বোচ্চ ১১৪ টাকা দরেও বিক্রি হচ্ছে। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই আগাম বাজারে ডলারের দাম বাড়তে থাকে। এই দর আগামী মাসের শুরুর দিক পর্যন্ত বহাল থাকতে পারে। অক্টোবরের শুরুতে ডলারের দাম আবার বাড়লেও আগাম বাজারেও তখন এর দাম বেড়ে যাবে।

এদিকে বাফেদা ও এবিবির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের মূল বাজার নিয়ন্ত্রণ করলেও আগাম ডলারের বাজার ও নগদ ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে না। ব্যাংকগুলোই চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে এটা নির্ধারণ করে। যে কারণে ব্যাংকগুলোর বাজার দরের চেয়ে আগাম বাজারে সর্বোচ্চ ৪ টাকা বেশি দামে বিক্রি করতে পারছে।

ব্যাংকগুলো সাধারণত নির্ধারিত মেয়াদের ভিত্তিতে এলসির দেনা ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের জন্য আগাম ডলার কিনে থাকে। কারণ এখন ডলারের সংস্থান ছাড়া এলসি খোলা যাচ্ছে না। এ কারণে আগাম ডলারের চাহিদা বেড়েছে। আর এ ক্ষেত্রে দামও বেশি। তারপর চাহিদার কমতি নেই। চড়া দামে ডলার কিনে ব্যয় মেটাতে হচ্ছে বলে আমদানির খরচও বেড়ে যাচ্ছে। এতে বাজারে বাড়ছে আমদানি পণ্যের দাম। এর প্রভাবে অন্যান্য পণ্যের দামও বাড়ছে। এতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশেই মূল্যস্ফীতির হার কমতে শুরু করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ হার বেড়েই যাচ্ছে। গত আগস্টেও এ হার বেড়ে ১০ শতাংশের কাছাকাছি চলে গেছে।

রপ্তানিকারকরা নিজস্ব উৎস থেকে এলসি খোলার ডলার পেলেও আমদানিকারকদের ডলারের নিজস্ব কোনো উৎস নেই। ফলে তারা ব্যাংকের ওপরই নির্ভর করে ডলারের জন্য। এক্ষেত্রে তারা এলসি খোলার জন্য ডলারের আগাম বুকিং দিয়ে রাখছে। যে কারণে আগাম ডলারের চাহিদা বাড়ছে। ফলে বাড়ছে দামও। এদিকে নগদ ডলার ৪টি ব্যাংক সর্বোচ্চ ১১৩ টাকা করে বিক্রি করছে। তবে বেশিরভাগ ব্যাংক ১১১ থেকে ১১২ টাকা করে বিক্রি করছে।

Pin It