সম্প্রতি বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন অস্কারজয়ী হলিউড তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের বিশেষ দূত হিসেবে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির ঘুরে দেখেছেন তিনি। মানবতার পক্ষে তিনি সব সময় কথা বলেছেন দৃঢ় গলায়। নারীর স্বাধীনতা প্রসঙ্গে ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর দ্য হলিউড রিপোর্টার আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি।
আমি কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি, এখানে উপস্থিত অনেক নারীরই আজকের দিনটি শুরু হয়েছে তাড়াহুড়োর মধ্য দিয়ে। সকালের নাশতা তৈরির সময় বাচ্চাদের বাড়ির কাজ চেক করতে করতে নিশ্চয়ই তাদের সঙ্গে দাঁত ব্রাশ করার গুরুত্ব প্রসঙ্গে খানিক তর্কও করতে হয়েছে। এ সময় হয়তো স্বামী বলে উঠেছেন, ‘নাও, এবার নিজে তৈরি হও। কীভাবে যে বাইরে বের হও তুমি!’ আর আপনি হয়তো ক্লান্তি নিয়ে খানিক ভেবে বলেছেন, ‘ঠিকই বলেছ।’ এটাই একজন নারীর জীবন। সবার আগে অন্যদের নিয়ে ভাবাই আমাদের স্বভাব।
আজকে যখন আমার সন্তানেরা আমাকে এখানে আসার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল, আমি ওদের নারীদের পাশে দাঁড়ানোর গুরুত্ব বুঝিয়েছি। বুঝিয়েছি পৃথিবীর সব নারীর বিষয়ে কথা বলার প্রয়োজনীয়তা। এখানে উপস্থিত প্রত্যেক নারীই আলাদা, কিন্তু তারপরও আমাদের ভেতর মৌলিক কিছু মিল রয়েছে। আমাদের নিজেদের মতো করে বাঁচার, নতুন কিছু সৃষ্টির, প্রচলিত প্রথা বা শাসনব্যবস্থাকে নির্ভয়ে চ্যালেঞ্জ করার অধিকার রয়েছে। আমরা ক্ষমতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অন্য নারীদের সঙ্গে সেটা উদ্যাপনও করতে পারি। আমরা যেভাবে সত্যকে দেখি, তা পৃথিবীকে জানানোর অধিকার রয়েছে।
আমাদের প্রত্যেকেই এমন সব নারীকে কাছ থেকে চিনি, যাঁরা জীবনে একটি দিনের জন্যও তাঁদের কল্পনার সৃষ্টিশীল জীবন যাপন করতে পারেননি। কেননা তাঁরা সব সময় পরিবারকে গুরুত্ব দিয়েছেন নিজের চেয়েও বেশি এবং তাঁদের সৃজনশীল স্বপ্নগুলো বাড়িতে জন্মদিনের অনুষ্ঠানের বিভিন্ন আয়োজনেই খরচ হয়ে গেছে। আমার মা-ও তাঁদেরই একজন। আমরা সবাই জানি, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে বৈচিত্র্য আর সমতার কত অভাব। এখনো এখানে অনেক কিছু রয়েছে, যেগুলো আমাদের পরিবর্তন করতে হবে, যেগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।
আমাদের যেটুকু করার স্বাধীনতা রয়েছে, সেটুকু পৃথিবীর বেশির ভাগ নারীর জন্যই অকল্পনীয়। অনেক নারী যুদ্ধ ও সন্ত্রাসের ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার, অনেকে আবার উৎখাত এবং দারিদ্র্যের শিকার। তাঁরা কখনোই জীবনে একটিবারের জন্যও সুযোগ পাননি। তাঁদের কথা, গল্প, দাবি বা চিৎকারে কেউ কখনো কান পাতেনি।
আমরা যেসব সিনেমা বানাই, রাজনীতি নিয়ে যেসব উটকো মন্তব্য করি বা মঞ্চে দাঁড়িয়ে যেগুলো নিয়ে কমেডি করি—সেগুলোর জন্য আমরা কখনো মাথা নিচু করি না। সেগুলোর জন্য আমাদের জেলে যেতে হয় না, কোনো শাস্তিও পেতে হয় না। এগুলোর জন্য আমাদের কোনো ‘সেন্সরশিপ’ নেই। আমরা একবারও ভাবি না যে আমাদের এসব কর্মকাণ্ড বিভাজন ও হিংস্রতার জন্ম দিতে পারে, আমাদের পরিবারকে অসম্মানিত করতে পারে।
নারী হিসেবে আমাদের ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় স্থান পায়নি, কেননা আমরা নিজেদের মনের কথা শুনিনি, সমাজের ভুলগুলো শোধরানোর কথা বলিনি। আমাদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার, সেগুলো নিয়ে কথা বলার এবং নিজেদের আইডিয়াগুলো নিয়ে কাজ করার সমান অধিকার রয়েছে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে এমন নারীরা রয়েছেন, যাঁরা শুধু মতপ্রকাশের ‘অপরাধে’ একটার পর একটা আঘাত সহ্য করেছেন, অনেক বড় ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে সেই ‘ভুলের’ মাশুল গুনেছেন। তাই আজকে আমরা গুটিকয়েক নারী যে অবস্থানে রয়েছি, এটি মোটেও তা উদ্যাপন করার সময় নয়। এটা সত্যি যে নারী হিসেবে, শিল্প ও সংস্কৃতির অংশীদার হিসেবে, আত্মপরিচয় তৈরির মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী আমাদের যে পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ছে, এটা আজকের পৃথিবীর জন্য আসলেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা হাতে গোনা এই কয়েকজন মানুষ যেটা করতে পারছি, সেটা মোটেও ‘বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তদের বিলাসিতা’ নয়, বরং প্রত্যেক নারীর মানবাধিকারের অংশ।
আমাদের সমাজ নারীদের মতপ্রকাশের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। এটা সেই সমাজ, যেটা গঠিত হয়েছে নারীদের কণ্ঠস্বর, ক্ষমতা, প্রভাব আর মেধাকে অস্বীকার করে। এ জন্য আমি হলিউড তথা পৃথিবীর সব সৃজনশীল মানুষদের নিয়ে গঠিত বৃহত্তর শিল্পী সম্প্রদায়ের একজন হতে পেরে খুবই গর্বিত। আজকে আমরা বাকি নারীদের স্বাধীনতা এবং অধিকারের জন্য লড়াই করছি, লড়াই করছি পৃথিবীর সবখানে তাঁদের আওয়াজ পৌঁছানোর জন্য, তাঁদের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্য, তাঁদের বিজয়কেতন ওড়ানোর জন্য। আমি এ লক্ষ্যে আপনাদের সবার সঙ্গে কাজ করতে চাই।
আমি আমার ব্যক্তিজীবনে এবং দীর্ঘ পেশাজীবনে অসাধারণ নারীদের সঙ্গে কাজ করেছি, যাঁরা আমাকে প্রতি মুহূর্তে শিখিয়েছেন, অনুপ্রাণিত করেছেন। তাঁদের সবাইকে হৃদয়ের গভীর থেকে ধন্যবাদ। পাশাপাশি আমি সেসব নারীকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি, যাঁরা আমাদের আগে এসে আমাদের জন্য নির্ধারিত সীমারেখাকে একটু একটু করে ঠেলে সরিয়েছেন, যেন আমরা আজ এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারি। সর্বোপরি আমি সেসব নারী শিল্পী, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী আর আইনজীবীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছি, যাঁরা কোনো কিছুতেই ভীত হননি। অসীম সাহসের সঙ্গে যাঁরা লড়াই চালিয়ে গেছেন, যেন আমরা একদিন স্বাধীনভাবে আমাদের জীবন যাপন করতে পারি। আমি আজ আপনাদের সামনে এখানে দাঁড়াতে পেরে সত্যিই গর্বিত।