‘আমার শহীদ ভাইয়ের আত্মা ডাকে/জাগে মানুষের সুপ্ত শক্তি, হাটে মাঠে ঘাটে বাঁকে/দারুণ ক্রোধের আগুনে জ্বালবো ফেব্রুয়ারি/একুশে ফেব্রুয়ারি, একুশে ফেব্রুয়ারি।’ বরেণ্য সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ কবিতার শেষ ক’টি লাইনের মতোই শহীদ ভাইয়ের আত্মার ডাকে বাঙালির কোটি প্রাণ আজ ভাই হারানোর শোকে মুহ্যমান। একই সঙ্গে দ্রোহের আগুনেও বলীয়ান। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ফাল্কগ্দুনের সোনাঝরা রোদ্দুরে নিজ ভাষায় কথা বলার দাবিতে, মায়ের মুখের ভাষার সম্মান প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে, প্রকাশ্য রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন বাংলার বীরসন্তানরা। রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের সেই স্মৃতিবহ মহান শহীদ দিবস, অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আজ। এদিন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জাতির শোকাবহ, গৌরবোজ্জ্বল, অহংকারে মহিমান্বিত চিরভাস্বর দিন। সব পথ এসে আজ মিলে যাবে এক অভিন্ন গন্তব্যে- শ্রদ্ধা-ভালোবাসার শহীদ মিনারে। হাতে হাতে বসন্তের ফুলের স্তবক, কণ্ঠে চির অম্লান সেই গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি ..’
পৃথিবীর বুকে ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে, অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেওয়ার ইতিহাস রয়েছে একমাত্র বাঙালি জাতির। একুশে ফেব্রুয়ারি তাই বাঙালির চেতনার প্রতীক। একুশের শহীদদের স্থান বাঙালির হৃদয়ের মর্মমূলে। অমর একুশে তাই আত্মত্যাগের অহংকারে ভাস্বর একটি দিন; জেগে ওঠার প্রেরণা। দেশমাতৃকার প্রয়োজনে আত্মোৎসর্গ করার শপথ গ্রহণের দিন।
ইতিহাসের পাতায় রক্ত পলাশ হয়ে ফোটা সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউর, আউয়াল, অহিউল্লাহর রক্তে রাঙানো অমর একুশে আজ বাঙালির দিশা, হৃদয়াপ্লুত ঐশ্বর্য, প্রাণের স্পন্দন। ১৯৫২ সালের এই দিনে শহীদদের শোণিতধারায় যে আলোকিত পথের উন্মোচন হয়েছিল, সেই পথ ধরে এসেছিল স্বাধীনতা। আজ আত্মমর্যাদায় সমুন্নত এক জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর অন্তহীন প্রেরণার নাম একুশে ফেব্রুয়ারি। একুশ এখন আর কেবল বাঙালির নয়, নয় শুধু বাংলাদেশের- সীমান্ত ছাড়িয়ে দিবসটি হয়ে উঠেছে বিশ্বমানবের। জাতিসংঘের সব সদস্য দেশ এই দিনে নিজ নিজ মাতৃভাষার কথা স্মরণ করে। উদযাপন করে দিবসটি।
মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, ‘নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় অমর একুশের চেতনা অনুপ্রেরণার অবিরাম উৎস।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেছেন, ‘একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে হবে। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জীবনে শোক, শক্তি আর গৌরবের প্রতীক।’
নানা আয়োজন, কর্মসূচি :ভাষাশহীদদের স্মরণে ‘জাতীয় শহীদ দিবস’ ও ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ বাংলাদেশ ও সারা বিশ্বে আজ পালিত হবে নানা আনুষ্ঠানিকতায়। রাষ্ট্রীয় আয়োজনে একুশের অনুষ্ঠানমালার সূচনা হয় বুধবার রাত ১২টা ১ মিনিটে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ-সংলগ্ন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা একুশের প্রথম প্রহরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। এর পর সর্বস্তরের মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হয় শহীদ মিনার।
দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে আজ সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন, রেডিও ও কমিউনিটি রেডিও দিনভর অনুষ্ঠানমালা প্রচার করছে। জাতীয় দৈনিকগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও সড়ক দ্বীপ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো বর্ণমালা সংবলিত ফেস্টুন দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে। আজ বিকেল সাড়ে ৩টায় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগ একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেছে। আজ বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে ৬টা থেকে সংগঠনের সব কার্যালয়ে পতাকা অর্ধনমিত ও কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। এ ছাড়া দিনভর নানা অনুষ্ঠান রয়েছে।
বিএনপি আজ বৃহস্পতিবার ভোর ৬টায় নয়াপল্টনে সারাদেশের সব কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত এবং কালো পতাকা উত্তোলন করবে। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি।
বিদেশে বাংলাদেশের সব মিশনে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যথাযথভাবে উদযাপিত হচ্ছে।