সংবিধানের আলোকে পরবর্তী ইসি চান ৫৪ বিশিষ্ট নাগরিক ** সব দলের ঐকমত্যে নতুন ইসি হওয়া উচিত :সিইসি হুদা ** সার্চ কমিটিকে অসাংবিধানিক বলা সংবিধানবিরোধী :কাদের ** সব বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে :ফখরুল
কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় দরকার হবে নতুন কমিশন গঠনের। নতুন কমিশনের অধীনেই হবে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠনের এখনো চার মাসের বেশি সময় অবশিষ্ট থাকলেও রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক অঙ্গনে এনিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। নতুন কমিশন গঠনের আগাম প্রস্তুতি হিসেবে কিছু প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে। কমিশন গঠনের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কিছু নির্দেশনা চেয়ে ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি সারসংক্ষেপ পাঠিয়েছে বলে জানা গেছে।
সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের নিয়োগকর্তা রাষ্ট্রপতি। ‘সার্চ কমিটি’র সুপারিশের মাধ্যমে বিগত দুটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। ঐ দুটি কমিশন নিয়োগের আগে রাষ্ট্রপতি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে দুটি সার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন। ঐ দুটি সার্চ কমিটির সুপারিশে গঠিত হয়েছিল রকিবউদ্দিন কমিশন ও নুরুল হুদা কমিশন।
পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ব্যবস্থা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো প্রশ্ন তোলেনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে সকল বিরোধী দলের মতামতের ভিত্তিতে একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের কথা বলছে বিএনপি। আর সংবিধানের আলোকে ‘আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে’ পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়ে ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ৫৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক। এছাড়া কেউ কেউ নির্বাচন কমিশন গঠনে সংবিধানের আলোকে আইন প্রণয়নের দাবি তুলেছেন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চার জন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।’ কিন্তু গত ৫০ বছরে কোনো সরকারই এই আইন তৈরির উদ্যোগ নেয়নি। ২০১১ সালে হুদা (এ টি এম শামসুল হুদা) কমিশন সর্বসম্মতিক্রমে একটি আইনের খসড়া প্রস্তুত করে সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছিল। তবে সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি।
পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে নানামুখী আলোচনার মধ্যেই এনিয়ে মন্তব্য করেছেন বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা। বুধবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেছেন, ‘সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন হওয়া উচিত। অবশ্যই এটা হওয়া উচিত। আমি এটাকে সমর্থন করি। যেন নতুন কমিশন সবার সমর্থনযোগ্য হয়, সেরকম একটি কমিশন হওয়া উচিত।’
রাজনৈতিক ঐকমত্য কীভাবে হতে পারে, এমন এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘এটা রাষ্ট্রপতি করতে পারেন। গতবার যেমন তিনি সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তবে এটা রাষ্ট্রপতির বিষয়। ঐকমত্যের বিষয়ে ইসির কোনো ভূমিকা থাকে না।’
কমিশন গঠনে সার্চ বা অনুসন্ধান কমিটি নিয়ে কারো কারো সমালোচনা এবং নতুন কমিশন গঠনের বিষয়ে বিএনপি নেতাদের বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষ্যে বৃহস্পতিবার রাজধানীর কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে স্বেচ্ছাসেবক লীগ আয়োজিত আলোচনাসভায় ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সার্চ কমিটিকে যারা অসাংবিধানিক বলছেন, তারা সত্যকে বিকৃত করছেন, সংবিধানবিরোধী কথা বলছেন। রাষ্ট্রপতিকে মানবেন না, সার্চ কমিটি মানবেন না; তা তো হয় না। গতবার সার্চ কমিটি করেছেন রাষ্ট্রপতি। সার্চ কমিটি করে নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা সংবিধানে আছে।’
পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে বিএনপি এখনো দলীয়ভাবে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য বা প্রস্তাব দেয়নি। তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমরা চাই, একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন। এ লক্ষ্যে সব বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের পরামর্শের ভিত্তিতেই গঠন করতে হবে নির্বাচন কমিশন। সবার মত উপেক্ষা করে সরকার একতরফাভাবে আজ্ঞাবহ ইসি পুনর্গঠন করলে তা জনগণ মেনে নেবে না।’
এদিকে, সংবিধানের আলোকে ‘আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে’ পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়ে গত ২৫ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ৫৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম; সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান, ড. আকবর আলি খান ও রাশেদা কে চৌধুরী; সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি আব্দুল মতিন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন রয়েছেন।
বিবৃতিদাতা বিশিষ্ট নাগরিকরা বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের উদ্যোগ এখনই শুরু করতে হবে, যার প্রাথমিক পদক্ষেপ হবে সাংবিধানিক নির্দেশনা অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চার জন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়ন করা।’
জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদেরও সম্প্রতি একাধিক বার নির্বাচন কমিশন গঠনে সংবিধান অনুযায়ী আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও গণসংহতি আন্দোলনের পক্ষ থেকেও সব রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি জানায়।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী গত ৬ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে পরবর্তী সিইসি পদে তিন জনের নাম প্রস্তাব করেছেন। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন, সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের নাম প্রস্তাব করে তাদের মধ্য থেকে এক জনকে সিইসি নিয়োগের দাবি জানান তিনি।