আল্লামা আহমদ শফীর ইন্তেকালে শূন্য হওয়া বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন মাওলানা মাহমুদুল হাসান।
গত শনিবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর ভাঙ্গাপ্রেসে অবস্থিত বেফাক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মজলিসে আমেলার অধিবেশনে দায়িত্বশীলদের প্রত্যক্ষ ভোটে তিনি বেফাকের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। এর আগে তিনি বেফাকের সহসভাপতি ছিলেন।
একান্ত প্রচারবিমুখ ও বরাবরই স্রোতের বিপরীতে চলা এই আলেম হঠাৎ করে বেফাকের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে চমকে দিয়েছেন পুরো কওমি অঙ্গনকে।
সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়াসহ সারা দেশের ইসলামপ্রিয় জনতা বিশেষত মাদ্রাসা শিক্ষিতদের মুখে মুখে তার নাম উচ্চারিত হচ্ছে সুনামের সঙ্গে।
সব সময় সব রকমের বিতর্ক এড়িয়ে চলে ও নিভৃতে মানুষ গড়ার কাজ করে তিনি এ সুনাম কুড়িয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। প্রায় ৫০ বছর ধরে নিভৃতে তিনি মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়ন ও ইসলাম প্রচারে কাজ করে যাচ্ছেন।
১৯৫০ সালের ৫ জুলাই ময়মনসিংহ সদরের চরখরিচা গ্রামে মাওলানা মাহমুদের জন্ম। বাবা গালীব উদ্দীন আহমাদ মা ফাতিমা রমজানী।
ময়মনসিংহের বালিয়া মাদ্রাসা, জামিয়া ইসলামিয়া মোমেনশাহী, জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ ও ঢাকার লালবাগ মাদ্রাসায় পড়াশোনা শেষে পকিস্তানের বিন্নুরি টাউন থেকে শিক্ষার সর্বোচ্চ শ্রেণি দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) সমাপন করেন।
বিন্নুরি টাউন থেকেই তিনি ফিকাহ, হাদিস ও তাফসিরের ওপর বিশেষ ডিগ্রি লাভ করেন।
আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী, আল্লামা ইদরিস মিরাঠী, আল্লামা শায়খ ওয়ালী হাসান ও আল্লামা হেদায়াতুল্লাহসহ বিশ্ববরেণ্য আলেমদের থেকে তিনি হাদিসের সনদ গ্রহণ করেন।
মাত্র ২৮ দিনে পবিত্র কোরআন শরীফ মুখস্ত করে অসাধারণ মেধা ও প্রখর স্মরণ শক্তির স্বাক্ষর রাখেন মাওলানা মাহমুদুল হাসান।
পাকিস্তানের জামিয়া ফারুকিয়ার সিনিয়র মুহাদ্দিস হিসেবে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন দেশবরেণ্য এই আলেম। বর্তমানে তিনি গুলশান সেন্ট্রাল মসজিদ ও ঈদগাহ সোসাইটির খতিব। জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া যাত্রাবাড়ী, ঢাকার প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদিস।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শতাধিক ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তার সার্বিক তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে অন্তত কয়েকশ’ ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এছাড়া তিনি আধ্যাত্মিক সংগঠন মজলিসে দাওয়াতুল হক বাংলাদেশের আমীর ও মাসিক আল-জামিয়া নামক একটি ইসলামী ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
ইসলামী লেখালেখির জগতেও রয়েছে মাওলানা মাহমুদুল হাসানের সরব পদচারণা। সম্পূর্ণ কোরআন শরীফের বিশদ তাফসির রচনা করেছেন তিনি। লিখেছেন প্রায় দুই শতাধিক গ্রন্থ।
দাওয়াতুল হক আওর দাওয়াত ও তাবলিগ, ইসলাম ও আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা, নবী পরিবারের প্রতি ভালোবাসা, হায়াতে আবরার, হায়াতে উসমানি, আল বুরহানুল মুআইয়াদ, তোহফায়ে আবরার, তোহফায়ে সুন্নাহ, আদর্শ মতবাদ, মাওয়েজে হাসানাহ, সিরাতে মুস্তাকিমের সন্ধানে তার উল্লেখযোগ্য রচনা।
আরবি ও উর্দু ভাষায় তিনি অনেক কিতাব রচনা করেছেন। তার রচিত ‘আর রদ্দুল জামিল’ আরব বিশ্বে সাড়া জাগানো একটি কিতাব।
আরব মুল্লুকে মাওলানা মাহমুদের বয়ান সংকলন ‘আল ইরশাদ ইলা সাবিলির রাশাদ’ একটি অনন্য বই। চার খণ্ডে রচিত ‘তাফসিরে বুরহানুল কোরআন’ পাঠকপ্রিয় গ্রন্থ।
আধ্যাত্মিক সাধনায় মাওলানা মাহমুদুল হাসানের সমকক্ষ আলেম বাংলাদেশে এ সময়ে খুব কমই আছেন। তিনি শাহ আবরারুল হক, শায়খ সাইয়্যেদ ইউসুফ হাশেম রেফায়ী, শায়খ সাইয়্যেদ মাহমুদ হাশেম রেফায়ী, শায়খ ইসহাক সিদ্দিকী, শায়খ দৌলত আলী, মাওলানা আবদুল মান্নান এবং আল্লামা আহমদ শফীর কাছ থেকে আধ্যাত্মিক খেলাফত লাভ করেছেন।
ইসলামের প্রচার-প্রসার, মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়ন, হাদিসের পাঠদান ও লেখালেখিই তার নেশা ও পেশা। সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন তার অগণিত ছাত্র, শিষ্য ও ভক্তকুল।
দ্বীনের জন্য নজিরবিহীন ত্যাগ, আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও ভরসা সর্বোপরি অসাধারণ আত্মমর্যাদাবোধই তাকে সবার মাঝে স্বাতন্ত্র্য মর্যাদার আসনে সমাসীন করে রেখেছে।
নিজেকে আড়াল করে রাখার এক বিস্ময়কর শক্তি আল্লাহ তাকে দিয়েছেন। ইসলাম ও মুসলমানদের সেবায় জীবন-যৌবন শেষ করা এই মাওলানাকে কখনও কেউ খ্যাতি ও যশের পেছনে ছুটেতে দেখেনি।
নিজেকে মানুষের সামনে প্রকাশ করার বিন্দুমাত্র অভিলাষ নেই তার। নিরবচ্ছিন্ন সাধনা, একনিষ্ঠ পরিশ্রম আর পরিকল্পিত জীবনযাপনই তাকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে এসেছে বলে দেশের শীর্ষ আলেমরা মতামত দিয়েছেন।
জানা গেছে, ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় আল্লামা আহমদ শফীর ইন্তেকালের পর থেকে হেফাজতে ইসলামের আমীর, হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহতামিম ও বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সভাপতি কে হবেন- সারা দেশের কওমি অঙ্গনে এ নিয়ে নানা রকমরে আলোচনা সমালোচনা চললেও মাওলানা মাহমুদুল হাসানের মতো জনপ্রিয় ও আস্থাশীল আলেম আহমদ শফীর এ পদে নির্বাচিত হওয়ার পরই সবাই একবাক্যে তাকে মেনে নিয়েছেন।
২০০৫ সালে বেফাকের সভাপতি মাওলানা নুরুদ্দীন আহমাদ গহরপুরীর ইন্তেকালের পর একই বছর বেফাকের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন আহমদ শফী। আমৃত্যু তিনি বেফাকের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
একই সঙ্গে গঠনতান্ত্রিকভাবে বেফাকের সভাপতি হিসেবে ২০১৭ সালে সরকারি স্বীকৃত আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়ার চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।
‘আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ এর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বেফাকের সভাপতি যিনি হবেন তিনিই হবেন আল-হাইয়াতুল উলইয়ার সভাপতি। সেই হিসেবে মাওলানা মাহমুদুল হাসানই হচ্ছেন আল হাইয়াতুল উলইয়ার পরবর্তী চেয়ারম্যান।