চুরির উদ্দেশেই দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের সরকারী বাস ভবনে ঢুকেছিল হামলাকারীরা। তারা বাসার পেছনের দিকের বাথরুমের ভেন্টিলেটর ভেঙ্গে ঢুকেছিল। চুরির সময় ইউএনও’র পিতা জেগে যান। এ সময় তিনি চোরদের দেখে ফেলায় চোর চোর করে চিৎকার করেন। তখন তাকে আঘাত করে হামলাকারীরা। তার চিৎকারে ইউএনও জেগে যান। তিনিও চোর চোর বলে চিৎকার দিতে থাকলে চোরেরা তাকেও মারাত্মকভাবে আঘাত করে। মূল হামলাকারী ছিল সান্টু। আর সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়া ফুটেজ মোতাবেক লাল গেঞ্জি পরিধান করেছিল আসাদুল ইসলাম। হামলার সঙ্গে জড়িত তিনজনকে গ্রেফতারের পর এমনটাই জানিয়েছে র্যাব-১৩। গ্রেফতারকৃত তিনজনই চুরির জন্য বাসায় ঢুকেছিল বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে জানিয়েছে র্যাব। হামলার ঘটনায় শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত ছয়জনকে আটক করা হয়েছে।
বুধবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাটের ইউএনও ওয়াহিদা খানমের সরকারী বাসায় হামলার ঘটনাটি ঘটে। হামলায় ওয়াহিদা ছাড়াও তার পিতা মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলী (৬০) মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। ঘটনাটি সারাদেশে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করে।
বৃহস্পতিবার রাতেই হামলার ঘটনায় ওয়াহিদা খানমের ভাই শেখ ফরিদ বাদী হয়ে ঘোড়াঘাট থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় অজ্ঞাত ৪-৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। ঘটনার পর পরই পুলিশ বাসভবনের নিরাপত্তা প্রহরী পলাশকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানা হেফাজতে নেয়। তার হাত পা বেঁধে হামলাকারীরা ভেতরে প্রবেশ করেছিল বলে পলাশ পুলিশের কাছে দাবি করেছেন।
এমন ঘটনার পর পরই দিনাজপুরের হাকিমপুর, বিরামপুর ও ঘোড়াঘাট এলাকায় র্যাব-১৩ রংপুরের একটি দল অভিযান চালায়। অভিযানে শুক্রবার ভোর পাঁচটার দিকে ঘোড়াঘাট উপজেলা যুবলীগের সদস্য আসাদুল ইসলাম (৩৫), সান্টু (৩৪) ও নবিরুল ইসলাম (৩৮) নামের তিনজনকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে নবিরুল পেশায় রং মিস্ত্রি। তাদের কাছ থেকে হামলায় ব্যবহৃত একটি হাতুড়ি উদ্ধার হয়েছে।
র্যাব-১৩ এর অধিনায়ক কমান্ডার রেজা আহমেদ ফেরদৌস আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে গ্রেফতারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে জানান, গ্রেফতারকৃত আসাদুল, সান্টু ও নবিরুল হামলার দায় স্বীকার করেছে। তারা মূলত চুরির উদ্দেশে ওয়াহিদা খানমের সরকারী বাসভবনের পেছনের বাথরুমের ভেন্টিলেটর ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকেছিল। ভেতরে ঢোকার পর পরই চুরির সময় প্রথমে ওয়াহিদার পিতা জেগে যান। তিনি চোর চোর বলে চিৎকার করতে থাকেন। এ সময় চোরেরা তার ওপর হামলা করে। তাকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে মারাত্মক জখম করে। তার পিতার চিৎকার শুনে ওয়াহিদা খানম জেগে যান। তিনিও চোর চোর করে চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকেন। এ সময় চোরেরা ওয়াহিদাকেও হাতুড়ি দিয়ে মারাত্মকভাবে আঘাত করে। তারা অচেতন হয়ে পড়ে গেলে লোকজন আসার আগেই চোরেরা পালিয়ে যায়।
গ্রেফতারকৃতরা চুরিতে বাধা দেয়ায় হামলা চালায় বলে দাবি করেছে। চুরিতে বাধা পেয়ে মূল হামলাটি সান্টু চালায় বলে গ্রেফতারকৃত আসাদুল দাবি করেছে। আর চুরির পরিকল্পনা করে নবিরুল। নবিরুল ও সান্টু দু’জনের ওপর হামলা করে।
এদিকে সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়া চোরদের ছবি মিলেছে। সেখানে লাল গেঞ্জি পরিহিত অবস্থায় যে ঢুকেছিল, সেই আসাদুল ইসলাম। এমন ঘটনার পেছনে প্রকৃত কারণ কি তা জানার চেষ্টা চলছে। নিছক চুরির ঘটনা নাকি এমন ঘটনার নেপথ্যে আরও কোন রহস্য আছে তা জানার চেষ্টা চলছে। গ্রেফতারকৃতদের রিমান্ডে পাওয়া গেলে, তাদের এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে হয়ত প্রকৃত কারণ জানা যাবে। তখন ঘটনার প্রকৃত কারণ জানানো হবে। তবে শুক্রবার সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা চুরির উদ্দেশে বাড়িতে ঢুকলে পরিস্থিতির মুখে হামলার ঘটনাটি ঘটায় বলে দাবি করেছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, ওয়াহিদা খানম ও তার বাবার ওপর হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ছয়জনকে আটক করা হয়েছে।
তারা হচ্ছে, ঘোড়াঘাট উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক (বহিষ্কৃত) জাহাঙ্গীর আলম (৪২), উপজেলা যুবলীগের সদস্য (বহিষ্কৃত) আসাদুল ইসলাম (৩৫), শিংড়া ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি দক্ষিণ দেবীপুর গ্রামের গোলাম মোস্তফা আদুর ছেলে মাসুদ রানা (৪০), নৈশপ্রহরী নাহিদ হোসেন পলাশ (৩৮), চকবামুনিয়া বিশ্বনাথপুর এলাকার মৃত ফারাজ উদ্দিনের ছেলে রং মিস্ত্রি নবিরুল ইসলাম (৩৫) ও একই এলাকার খোকার ছেলে সান্টু চন্দ্র দাশ (২৮)। এদের মধ্যে কতজনকে হামলার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় গ্রেফতার দেখানো হবে, তা এখনও নিশ্চিত নয়। ঘটনার তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে হামলার প্রকৃত কারণ জানা যাবে বলে পুলিশের তরফ থেকেও জানানো হয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আটককৃতদের মধ্যে জাহাঙ্গীর হোসেন ঘোড়াঘাট উপজেলার ওসমানপুর সাগরপাড়া এলাকার আবুল কালামের ছেলে। তিনি ঘোড়াঘাট উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। ২০১৭ সালে কমিটি ভেঙ্গে দিলে তিনি আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন।
আসাদুল ইসলাম ঘোড়াঘাট উপজেলার রানিগঞ্জের আমজাদ হোসেনের ছেলে। অন্যদিকে মাসুদ ঘোড়াঘাট উপজেলার ৩নং সিংড়া ইউনিয়ন যুবলীগের সদস্য।
এদিকে ঢাকার শেরে বাংলা নগর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সাইন্স এ্যান্ড হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ওয়াহিদা খানমের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তবে তিনি এখনও শঙ্কামুক্ত নন। ইতোমধ্যেই তার অবশ হয়ে পড়া হাত পায়ে কিছুটা শক্তি ফিরে এসেছে। তিনি কিছুটা স্বাভাবিক কথাবার্তাও বলতে পারছেন। বৃহস্পতিবার রাতেই অস্ত্রোপচারের পর তার জ্ঞান ফিরে। এরপর তিনি স্বামী রংপুর জেলার পীরগঞ্জের ইউএনও মেজবাহুল হোসেন ও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন।
ইতোমধ্যেই হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে দুই যুবলীগ কর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা ছাড় পাবে না বলে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ইউএনও-র মাথার খুলির হাড় ভেঙ্গে ভেতরে মস্তিষ্কে ঢুকে গিয়েছিল। তার শরীরের অনেক অংশ অবশ হয়ে পড়েছিল।
শুক্রবার ওয়াহিদা খানমের চিকিৎসায় ছয় সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সাইন্স এ্যান্ড হসপিটালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিউরো ট্রমা বিভাগের প্রধান নিউরো সার্জন অধ্যাপক জাহিদ হোসাইন জানান, শুক্রবার ইউএনও-র সিটি স্ক্যান রিপোর্ট এসেছে। রিপোর্ট শতভাগ ভাল। চিকিৎসক ও স্বামীর সঙ্গে কথাও বলেছেন তিনি। অস্ত্রোপচারের পর রাতেই তার জ্ঞান ফিরে। বর্তমানে তাকে হাসপাতালের আইসিইউতে ৭২ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তারপরেও তিনি শতভাগ শঙ্কামুক্ত নন।
এছাড়া ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সাইন্স হাসপাতালের উপ-পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ বদরুল আলম জানান, তার হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ স্বাভাবিক আছে। তবে তার স্বাস্থ্যগত সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে এখনই সিদ্ধান্ত নেয়ার পর্যায়ে আসেনি। আরও পর্যবেক্ষণ শেষে মেডিক্যাল বোর্ড বসে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
শনিবার মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্যরা বৈঠকে বসছেন। সার্বিক দিক পর্যালোচনা শেষে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
চিকিৎসকরা জানান, আঘাতে মাথার হাড় ৭-৮ টুকরো হয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। সেগুলো জোড়া দেয়া হয়েছে। আঘাতের কারণে আরও ছোট ছোট যে কাঁটা ছিল সেগুলোও ঠিক করা হয়েছে। মাথার ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, কয়েকদিন আগেও পৌর মেয়র আব্দুস সাত্তার মিলনের ওপর ত্রাণ বিতরণের সময় হামলা চালিয়েছিল তারা। তাদের বিরুদ্ধে হামলা, চাঁদাবাজি, মাদকসেবনসহ বিভিন্ন অভিযোগে একাধিক মামলা আছে। আটককৃতদের প্রায় সবাই মাদকাসক্ত। জাহাঙ্গীর আলম ও আসাদুল ইসলামকে দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ ও সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান খান নিখিল।
এ ঘটনায় রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) জাকির হোসেনকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজির একজন প্রতিনিধি এবং দিনাজপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আসিফ মাহমুদ। ঘটনা তদন্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে গঠিত সাত সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে।
ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার পর রংপুর বিভাগের ৫৮ উপজেলার ইউএনওদের নিরাপত্তায় ১০ জন করে সশস্ত্র আনসার নিয়োগ করা হয়েছে।