যুদ্ধের ময়দান ইউক্রেইনে বাস আর বিমান চলাচল বন্ধ, রেল চালু থাকলেও সূচির কোনো বালাই নেই। চড়া ভাড়ায় ট্যাক্সি মেলে, তবে রাশিয়ার হামলার মধ্যে সেই পথও অনিশ্চিত। কিন্তু নিরাপত্তা চাইলে সীমান্তের কাছে যে পৌঁছাতেই হবে !
রুশ বাহিনী আগ্রাসন শুরুর পরদিনই পৌঁছে গেছে রাজধানী কিয়েভের উপকণ্ঠে। অন্যদিকে নিরপাদ আশ্রয়ের আশায় দলে দলে ইউক্রেইন ছাড়ছে মানুষ, ছুটছে সীমান্তের দিকে, তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরাও, যাদের অনেকেই শিক্ষার্থী।
পূর্বে রাশিয়া, উত্তরে বেলারুশ আর দক্ষিণে কৃষ্ণ সাগর দিয়ে বৃহস্পতিবার ভোরে আক্রমণ শুরু হয়েছিল। ফলে পালানোর সুযোগ আগে কেবল পশ্চিমে। সেদিকে আছে পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া আর মলদোভা।
পশ্চিমের প্রতিবেশীরা বিদেশিদের ভিসা ছাড়াই প্রবেশের সুযোগ দিচ্ছে। কিন্তু প্রবাসী এই বাংলাদেশিদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হল সীমান্তে পৌঁছানো; যেখান থেকে তাদের ফেরানোর পরিকল্পনা করেছে সরকার।
রাজধানী কিয়েভের দ্রুজভি নারোডিভ এলাকা থেকে প্রবাসী বাংলাদেশি মাহবুব পারভেজ বলেন, “রোড ট্রান্সপোর্টের ভালো একটা ব্যবস্থা নাই। কিছু কিছু জায়গায় রেল চলছে, মানুষ বিভিন্ন জায়গা থেকে রেলে চলে যাচ্ছে।
“কিন্তু এটা খুবই ভয়ানক…। তবু মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা করছে সরে যাওয়ার জন্য।”
কিয়েভ থেকে পোল্যান্ড সীমান্তের দূরত্ব পাঁচশ কিলোমিটার বেশি। অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রেও সামান্য কম-বেশি হবে। ফলে নিজস্ব বাহন না থাকলে সেই চেষ্টা করাও কঠিন।
মাহবুব পারভেজ বলেন, “বাংলাদেশিরা বিভিন্ন জায়গা থেকে চেষ্টা করতেছে বর্ডার এলাকায় যাওয়ার জন্য। বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে যাচ্ছে, এখানে ট্যাক্সি খুবই এক্সপেনসিভ। জীবন বাঁচাতে চড়া দামই গুনছেন তারা।”
ইউক্রেইনে আটকেপড়া বাংলাদেশিদের পোল্যান্ড হয়ে ফেরানোর পরিকল্পনাই শুরুতে করেছিল সরকার, সে অনুযায়ী যোগাযোগও রক্ষা করা হচ্ছিল প্রবাসীদের সাথে।
এরপর পোল্যান্ড সীমান্তে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ায় রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া ও মলদোভা সীমান্ত দিয়েও বাংলাদেশিদের পার করার পরিকল্পনা হয়েছে।
সরকার বলছে, পোল্যান্ডের ওয়ারশ এবং রোমানিয়ার বুখারেস্টের দুই বাংলাদেশ দূতাবাস সীমান্ত এলাকায় ইউক্রেইন প্রবাসীদের পারাপারে সহযোগিতা করবে।
রাশিয়ার হামলা থেকে বাঁচতে পাতাল রেলস্টেশনে আশ্রয় নিয়েছে কিয়েভের বাসিন্দারা
ওয়ারশ দূতাবাস জানিয়েছে, শুক্রবার বিকালে পোল্যান্ড-ইউক্রেইন সীমান্তে গেছে দূতাবাসের একটি দল। ইউক্রেন থেকে পোল্যান্ডে ঢুকতে বাংলাদেশিদের তারা সহায়তা করছেন।
ইউক্রেইন-পোল্যান্ড সীমান্তের লিভিভ অঞ্চলের সীমান্ত এলাকায় বুদোমেজ হ্রুশিভ চেকপয়েন্টে দূতাবাসের প্রতিনিধিরা অবস্থান করছেন। বিয়েৎজজেজাসকি বর্ডার গার্ড ইউনিটের ওই চেকপয়েন্ট রাজধানী কিয়েভ থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরে।
ওয়ারশ’তে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা হোসেন জানান, প্রথম দফায় শুক্রবার সকালে সাতজন বাংলাদেশির একটি দল পোল্যান্ডে প্রবেশ করতে পেরেছে। এর বাইরে আরও অনেকেই ইউক্রেইন থেকে ওই সীমান্তের দিকে আসছেন।
“আজকে অল্প কিছু লোক এসেছে। আরও অনেকে বর্ডারের ওই পারে ঢোকার অপেক্ষায় আছে। তারা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। ওই পাশে ইউক্রেইন থেকে পোল্যান্ড বর্ডারের দিকে প্রচুর যানজট। তারা আমাদের প্রতিনিয়ত আপডেট দিচ্ছে।”
যানজটের কারণে সীমান্ত পার হতে সময় লাগছে জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, “আমাদের লোক অনেকক্ষণ ধরে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। এভাবে সারারাত ধরে চলবে মনে হয়, দেখা যাক কি হয়।”
ইউক্রেইন থেকে হাঙ্গেরিতে ঢোকার জন্য আরেকটি বড় দল সীমান্তের দিকে এগোনোর কথা জানিয়ে রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা বলেন, রোমানিয়া ও স্লোভাকিয়া সীমান্তের দিকেও কিছু লোক যাওয়ার কথা তারা শুনেছেন। তবে সীমান্তে মোবাইল নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও কিছুটা জটিলতা হচ্ছে।
“আমাদের যে টিম, তারাও কোনো কোনো সময় আধা ঘণ্টার মত ড্রাইভ করে গিয়ে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে হচ্ছে।”
ইউক্রেইন প্রান্তেও যাতায়াতের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করার কথা জানিয়ে সুলতানা লায়লা বলেন, “সীমান্তের বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরে গাড়ি নামিয়ে দেয়। ওখান থেকে অনেকখানি হেঁটে আসতে হয়। সেখানেও পোলিশ এক লোকের মাধ্যমে গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। যদি কারও প্রয়োজন হয়, ব্যবহার করতে পারবেন।”
গাজীপুরের জয়দেবপুর উপজেলার মাহবুব পারভেজ ইউক্রেইনে আছেন নয় বছর ধরে। এইচএসসি পাশের পর শিক্ষার্থী ভিসায় পূর্ব ইউরোপের দেশটিতে পাড়ি জমান মাহবুব। কিয়েভ ন্যাশনাল টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইন থেকে স্নাতক শেষ করে সেখানেই একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি শুরু করেন।
তিনি জানান, যারা শিক্ষার্থী কিংবা ইউক্রেইনে যেসব অনিয়মিত বাংলাদেশি অভিবাসী আটকা পড়েছেন, তাদের জটিলতা সবচেয়ে বেশি। অনেকের হাতে সীমান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করার মত টাকাও নেই।
“বাংলাদেশিরা এখন ট্রেন কিংবা ট্যাক্সিতে করে লিভিভ, উজহুরভসহ বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি সীমান্তের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে। রাস্তায় অনেক মানুষ, অনেক লম্বা ট্রাফিক এখানে। সবাই চেষ্টা করতেছে যে কোনো মূল্যে বর্ডার এরিয়ায় যাওয়ার জন্য।”
মাহবুব পারভেজ নিজে হাঙ্গেরির দিকে যাওয়ার কথা ভাবছেন। তবে আতঙ্কের কথাও তিনি বলেছেন।
“মানুষ অনেকটা প্যানিকে আছে, বুঝতে পারতেছে না কী করা উচিত। তারা বিভিন্ন বাংকারে বা ডাম্পিংয়ে ঢুকতেছে। ঢোকার পর আমার যে অভিজ্ঞতা, প্রচণ্ড আওয়াজ পাওয়া যায়। এমন আওয়াজে অভ্যস্ত না হওয়ায় আরও ভয় পাচ্ছে সবাই।”