ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি) নির্বাচনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষতার মাধ্যমেই জাতির পিতাকে শ্রদ্ধা জানাতে চান বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। একই সঙ্গে তিনি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে নিজ দলের সমর্থক ও ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগ করেছেন।
বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে আয়োজিত ঢাকার দুই সিটি ভোটের আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বৈঠকে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে বক্তব্য দেওয়ার সময় তিনি এসব কথা বলেন। রুদ্ধদ্বার বৈঠকে তিনি এ বক্তব্য দিলেও সভা শেষে গণমাধ্যমে তার বক্তব্যের লিখিত কপি মেইলে পাঠানো হয়। বৈঠকেও তিনি একই বক্তব্য দিয়েছেন বলে উপস্থিত একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) অন্য কমিশনারদের অবস্থানের বাইরে গিয়ে তিনি সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন ও দেশের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে অনেক বিষয়ে তার অবস্থান তুলে ধরেন। তার পরপরই সিইসি বক্তব্য রাখলেও তিনি এসব অভিযোগের কোনো জবাব দেননি। তবে বলেছেন, ‘কোন ফোরামে কোন বক্তব্য দেওয়া উচিত’ সেই বিবেচনাবোধ সবার থাকা উচিত।
ইসি মাহবুব তালুকদার বলেন, ঢাকার এই নির্বাচনকে ঘিরে রাজধানীবাসীর উৎসুক্য ও উদ্বেগ অন্তহীন। নির্বাচন নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, বর্তমান প্রক্রিয়া থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার। তবে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে সংস্কার করতে চায়, জনগণের স্বার্থে নয়। দলীয় স্বার্থে সংস্কার কার্যক্রম কখনও সচল, কখনও অচল করে রাখা হয়।
বিচ্ছিন্ন দু-একটি ঘটনা ছাড়া দুই সিটির ভোটের বর্তমান পরিস্থিতিতে আশাবাদী উল্লেখ করে ইসি মাহবুব বলেন, গত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে এসবের কিছুই দৃশ্যমান ছিল না। নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে নির্বাচন কমিশনের অধীন, তা দৃশ্যমান নয়। নির্বাচন-সংশ্নিষ্ট পুলিশ আইনানুগভাবে কমিশনের কাছে ন্যস্ত, মানসিকভাবে নয়। সেটা না হলে কোনো ফল হবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতি উৎসাহী সদস্যদের আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে বা প্রয়োজনে নিষ্ক্রিয় থাকতে দেখা যায়। দুই সিটি নির্বাচনে এ ধরনের ঘটনা থেকে বিরত থাকার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরদারি একান্ত জরুরি।
মাহবুব তালুকদার বলেন, তফসিল ঘোষণার পর ওয়ারেন্ট ছাড়া কিংবা নতুন ওয়ারেন্ট বা আগের ওয়ারেন্ট দিয়ে গ্রেপ্তার নির্বাচন কমিশনের নির্দেশের বরখেলাপ। জরুরি ক্ষেত্রবিশেষ ছাড়া গ্রেপ্তার কার্যক্রম নির্বাচনের পরে হলে অসুবিধা কী? অনেক সময় এসব গ্রেপ্তারে কমিশনের ভাবমূর্তির ক্ষতি হয়।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতভেদ আছে উল্লেখ করে মাহবুব তালুকদার বলেন, আগে বিরোধিতা করলেও দুটি কারণে তিনি ইভিএমের পক্ষে। যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, এতে ভোটের আগের রাতে ব্যালট পেপারে বাপ ভর্তি করার সংস্কৃতির অবসান ঘটতে পারে এবং একশ’ ভাগ ভোট পড়ার অভিজ্ঞতারও অবসান হবে। সংসদের ১০৩টি আসনের ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। বিশ্বের কোনো নির্বাচনেই এ ধরনের ভোটার উপস্থিতির নজির নেই। রাতে ব্যালট পেপারে বাপ ভর্তি ও কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ার অপবাদ থেকে কমিশন মুক্ত হতে চায়।
ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতাকারীরা তাদের সমর্থক ভোটারদের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে, এমন অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচনে সব কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহারের ফলে ২২ দশমিক ৯৪ শতাংশ ভোট পড়েছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ব্যালট পেপারে যে ২৯৪টি আসনে ভোট হয়েছে সেখানে ভোটের হার ছিল শতকরা ৮০ ভাগ। ইভিএম ব্যবহারে ২৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ কম ভোট পড়েছে। এর কারণ ইভিএম নিয়ে ভোটারদের মনে ভীতি রয়েছে। অন্যদিকে ইভিএমে জাল ভোট দেওয়া এক বিরাট সমস্যা। বুথ দখল করে বা গোপন কক্ষে গিয়ে জাল ভোট দেওয়ার ঘটনা অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে। সিটি নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি বাড়ানো একান্ত অপরিহার্য মন্তব্য করে এজন্য তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি বলেন, এই নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সাফল্যের ওপর নির্ভর করছে এ যন্ত্রটির ভবিষ্যৎ। নির্বাচনে শতকরা ৫০ ভাগ ভোট না পড়লে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বা সবার জন্য সমান সুযোগ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার পূর্বশর্ত। নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে এই দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়। এজন্য সরকার, সরকারি দল ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা প্রয়োজন।
মাহবুব তালুকদার বলেন, নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলে তার দায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর পড়বে। তারা প্রশ্নবিদ্ধ হলে তার দায় কমিশনের ওপর বর্তাবে। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করে কলঙ্কিত হতে চাই না। ভোটার ও প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, পুলিশ নিরপেক্ষ না থাকলে ভোট গ্রহণযোগ্য হবে না। নির্বাচনে কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এক ও অভিন্ন সত্তা। তাই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠিত করে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে। ইসির ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থার সংকটও কাটাতে হবে। রেফারির ওপর আস্থা না থাকলে খেলার জয়-পরাজয় কোনো দলের কারও জন্যই সুখকর হবে না।
তিনি বলেন, ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন হচ্ছে মুজিববর্ষে। এ নির্বাচন সুন্দর, সুষ্ঠু, অবাধ নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত করার মাধ্যমে জাতির পিতার প্রতি সর্বোত্তম উপায়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।