মহামারীকালে উপার্জন হারিয়ে কোণঠাসা হলেও দমে যাননি; নিজের তৈরি পণ্য ফেইসবুকের মাধ্যমে বিক্রি করে বাজিমাত করেছেন দেশের একঝাঁক নারী উদ্যোক্তা।
ঢাকার পূর্বাচলে শুক্রবার শতাধিক নারী উদ্যোক্তার পণ্য নিয়ে শুরু হওয়া দুই দিনের মেলায় এমন অনেক সফলতার গল্প শোনালেন উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম বা উইয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নাসিমা আক্তার নিশা।
পূর্বাচল ক্লাব প্রাঙ্গণে ‘উই কালার ফেস্ট’ নামে মেলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা উদ্যোক্তারা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। ফেইসবুক পেইজের ওপর ভর করে নিজেদের পণ্য দেশ-বিদেশে বিক্রি করে লাভের মুখ দেখেছেন তারা।
উই- হচ্ছে দেশীয় পণ্য বিপণন ও ব্যবসা উদ্যোগের একটি সামাজিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এই পেইজে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের মধ্যে সমন্বয় করে দেওয়ার কাজটি করা হয়, কীভাবে পণ্যের ব্র্যান্ডিং করা যায়, ব্যবসার প্রসার ঘটানো যায় সে বিষয়ে পরামর্শও দেওয়া হয়।
প্রযুক্তি উদ্যোক্তা নাসিমা আক্তার নিশা ২০১৭ সালে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এই প্ল্যাটফর্ম চালু করলেও পুরুষদের জন্যও এখন এই পেইজটি উন্মুক্ত করা হয়েছে।
তিনি জানান, কোভিড-১৯ শুরুর আগে ফোরামের সদস্য ছিল ৩০ হাজার। মাত্র চার মাসে জুনে তা বেড়ে তিন লাখ ছাড়িয়ে যায়।
মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নাসিমা বলেন, “সাড়ে ৩০০ নারী উদ্যোক্তা লাখ টাকার পণ্য বিক্রির মাইলফলক ছুঁয়ে গেছেন। এর মধ্যে ১০ জনেরও বেশি উদ্যোক্তা ১০ লাখ টাকার বেশি পণ্য বিক্রি করেছেন। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশীয় পণ্য এখন বাইরের দেশেও রপ্তানি শুরু হয়েছে।”
শূন্য থেকে ২০ লাখ টাকার পুঁজি
উই কালার ফেস্টে যেসব নারী উদ্যোক্তা অংশ নিয়েছেন গত এক বছরে, তাদের সবাই ছোটবড় সাফল্যের সাক্ষী হয়েছেন। কখনও নিজ হাতে তৈরি পণ্য, কখনও দেশীয় পণ্যের বিপণন করে মুনাফা হাতে পাওয়ার পর তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে কয়েকগুণ। সখের বসে শুরু করা এফ-কমার্সকে তারা এখন আর্থিক সচ্ছলতা ও ভবিষ্যত নির্মাণের উপায় হিসাবে বেছে নিয়েছেন।
এমনই একজন সফল উদ্যোক্তা সিলেটের মেয়ে সুলতানা পারভীন, যিনি গত বছর মার্চে অচেনা এক মহামারীর ধাক্কায় চাকরি হারিয়ে বাসায় ঢুকেছিলেন।
সুলতানা বিডিনিউজ টেয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিলেটে একটি কোম্পানির জিএম পদে চাকরি করছিলাম। করোনার কারণে সেই চাকরি আর চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তখন বাসায় বসে বসে সিলেটের বেতপণ্য নিয়ে কিছু একটা করার কথা ভাবতে থাকি।
“আমি ফেইসবুকে লাইভে এসে কোনো পণ্যের প্রচারণা চালাইনা। পণ্যের ছবি ফেইসবুকে দিয়ে ভেতরে বিশদ বর্ণনা দেই। শুরু থেকেই প্রি-পেইমেন্ট পদ্ধতিতে পণ্য বিক্রি শুরু করে। প্রথমবার বেতের তৈরি একটি দোলনা ও একটি রকিং চেয়ারের অর্ডার পেয়েছিলাম কক্সবাজারের চকরিয়া থেকে। সেই থেকে আমার বেতপণ্যের ব্যবসা শুরু। চলতি মাস পর্যন্ত আমি প্রায় ২১ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেছি।”
নিজে মুনাফা করার পাশাপশি করোনার ওই সময়ে সিলেটের বেতশিল্পীদের পাশেও দাঁড়াতে পেরেছিলেন সুলতানা।
তিনি বলেন, “মার্চের দিকে সবকিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় বেতশিল্পের কাজও থেমে যায়। টাকার অভাবে বাড়িভাড়াটাও পর্যন্ত দিতে পারছিলেন না। আমি কয়েকজনকে পণ্যের অর্ডার দেই, নিজের তৈরি ডিজাইন তাদের সামনে তুলে ধরি। এভাবে আবার কাজে যুক্ত হয় তাদের কেউ কেউ।”
দেশি বুটিকস, নানা রকম আচার, মসলা, কাঠের সৌখিন পণ্য, শতরঞ্জি, পদ্মার ইলিশ, গুড়, সন্দেশ, মুড়ি-মুড়কি-বাতাসা, শীলতপাটি, মোড়াসহ অসংখ্য পণ্য তৈরি ও বিপণনের কাজে যুক্ত হয়ে সফল হয়েছেন উইয়ের সদস্যরা।
মেলায় ১০০টি স্টলের ৪০টিতে রয়েছে রপ্তানিযোগ্য পণ্য। অনলাইনে পণ্য দেখে কুয়েত থেকে একজন ক্রেতা এই মেলায় যুক্ত হয়েছেন।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পররাষ্ট্র মন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেন, “এই উদ্যোগে যুক্ত হয়ে ৩৫০ নারী লাখপতি হয়েছেন। কয়েকজন হয়েছেন মিলিয়নিয়ার- এটাই হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন।”
আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, নারী উদ্যোক্তাদের প্ল্যাটফর্ম উই আজকে ১০ লাখ ক্রেতা-বিক্রেতার ঠিকানা। ডিজিটাল প্রযুক্তির সুফল কাজে লাগিয়ে দেশে উদ্যোক্তা ও কর্মসংস্থানের পরিমাণ প্রত্যাশার চেয়েও বেশি হচ্ছে।
“গত ১২ বছরে ই-কমার্সে প্রবৃদ্ধি ছিল ২৫ শতাংশ। আর মহামারীর মধ্যে ইকমার্সের গ্রোথ হচ্ছে ৩০০ শতাংশ। ”
ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী বলেন, যে কোনো সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন এগিয়ে থাকার সূচক। এজন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির সবচেয়ে টেকসই পথ। উই যেটা করছে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ব্যবসা-বাণিজ্য নারীর ক্ষমতায়নের পথ সুগম করে।
নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশ একসাথে কাজ করতে পারে এবং একদেশ অন্য দেশকে সহায়তা করতে পারে বলে আশা করেন দোরাইস্বামী।