ঈদের বাকি আর মাত্র একদিন। প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে অনেকে হয়তো ইতিমধ্যে ঢাকা ছেড়েছেন। আবার শেষ মুহূর্তেও অনেকে গ্রামে ছুটছেন। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার পরিস্থিতি একটু অন্যরকম। সারাদেশে ডেঙ্গু আতঙ্ক। রাজধানী ঢাকা ছাপিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা- ঈদের ছুটিতে গ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে পারে। যুক্তি হিসেবে তারা বলেছেন, ডেঙ্গু সংক্রমিত কোনো ব্যক্তি গ্রামে গেলে সেখানে কোনো মশা তাকে কামড় দিলে ওই মশাও সংক্রমিত হবে। আবার ওই মশা অন্য কাউকে কামড় দিলে সেই ব্যক্তিও সংক্রমিত হবে। এভাবে গ্রামেও পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের এ আশঙ্কার কথা তুলে ধরে জানতে চাইলে সরকারের জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ঢাকা থেকে গ্রামে যাওয়া মানুষের মধ্যে কেউ কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত থাকতে পারেন। কারও হয়তো জ্বর থাকবে, আবার কারও হয়তো জ্বর নেই। কিন্তু গ্রামে গিয়ে জ্বরে আক্রান্ত হতে পারেন। আবার কেউ কেউ হয়তো জ্বর হওয়ার আগেই ডেঙ্গু ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন, অথচ টের পাননি। তিনি হয়তো গ্রামে চলে যাবেন। এভাবে ভাইরাস দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ওই পরিচালক আরও বলেন, এডিস মশা এখনও শহরকেন্দ্রিক। এই মশা সাধারণত একশ’ থেকে চারশ’ মিটারের বেশি উড়তে পারে না। কিন্তু পরিবহনের মাধ্যমে এটি এক স্থান থেকে অন্যত্র যেতে পারে। এ জন্য পরিবহন বাস, ট্রেন, লঞ্চসহ সর্বত্র সচেতনতামূলক কার্যক্রম আগেভাগেই গ্রহণ করা হয়েছে। পরিবহনগুলোতে স্প্রে, অ্যারোসল ব্যবহার করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গ্রামে খুব একটা ডেঙ্গুর প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞদের ধারণার সঙ্গে সরকারি পরিসংখ্যানের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। গত তিন দিনের হিসাব থেকে দেখা যায়, ঢাকার বাইরে রোগী বেড়েছে। ৮ আগস্ট থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিনই ঢাকার বাইরে রোগী বেড়েছে। গ্রামে গিয়ে কেউ আক্রান্ত হলে সুরক্ষার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছে। এসব পরামর্শ মেনে চললে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সুরক্ষিত থাকবেন বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা।
গ্রামে গিয়ে আক্রান্ত হলে করণীয় : ঈদে গ্রামে গিয়ে কেউ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে কীভাবে সুরক্ষিত থাকতে পারবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সংক্রামক ব্যাধি) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, গ্রামে গিয়ে কেউ জ্বরে আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন, হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া রক্ত পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। সংশ্নিষ্ট চিকিৎসক না বলা পর্যন্ত স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতালে চিকিৎসা নেবেন। স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে জেলা, বিভাগ কিংবা আরও কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা নেবেন।
অযথা হাসপাতালে ছোটাছুটিরও প্রয়োজন নেই উল্লেখ করে পরিচালক বলেন, জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বেশি করে তরল খাওয়াতে হবে। খাবার স্যালাইন, বিভিন্ন ধরনের শরবত খাওয়াবেন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে আইভি ফ্লুইডের সংকট হয়। এ জন্য স্যালাইন ব্যবহার করতে হবে। অ্যাম্বুলেন্সে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে রোগীকে স্থানান্তর করার সময় শরীরে যেন স্যালাইন পুশ করা হয়। তাহলে রোগী জটিল পরিস্থিতিতে পড়বে না। গ্রামের বাড়ির আশপাশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে মশারির মধ্যে রাখতে হবে। তাহলেই সুস্থ থাকা সম্ভব। সর্বোপরি আতঙ্কের কিছু নেই।
ঢাকা ছাড়ার আগে পরামর্শ : ঈদের দীর্ঘ ছুটিতে যারা গ্রামে যাচ্ছেন তাদের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছে। এ পরামর্শ মেনে চললে ডেঙ্গুর চলমান প্রকোপ মোকাবেলা করা সহজ বলে মনে করেন সংশ্নিষ্টরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঢাকা ত্যাগ করার আগে বাসাবাড়ি, অফিসসহ সব প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টয়লেটের হাই ও লো কমোড ঢেকে রেখে যাবেন। রেফ্রিজারেটরের ট্রের পানি ফেলে শুকিয়ে রেখে যাবেন। এয়ারকন্ডিশনারের পাইপের পানিসহ যে কোনো পানি শুকিয়ে পরিস্কার করে রাখতে হবে। বালতি, বদনা, হাঁড়ি-পাতিল, ড্রাম, গামলা, ঘটি-বাটির পানি ফেলে পরিস্কার করে উল্টিয়ে রেখে যেতে হবে। বারান্দা ও বাসার ছাদের ওপর রাখা ফুলের টবের ট্রের পানি ফেলে পরিস্কার করে উল্টিয়ে রাখতে হবে। পানির ট্যাংকের ঢাকনা বন্ধ করে রেখে যেতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, আত্মীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে ইতিমধ্যে লাখ লাখ মানুষ ঢাকা থেকে গ্রামে চলে গেছেন। আবার শেষ মুহূর্তেও অনেকে গ্রামের উদ্দেশে ছুটছেন। গ্রামে যাওয়া মানুষের উদ্দেশে আগে থেকেই আমাদের পরামর্শ ছিল- জ্বর নিয়ে কেউ যেন গ্রামে না যান। জ্বর এলে অন্তত রক্ত পরীক্ষা করে ডেঙ্গু নিশ্চিত হলে কোনোভাবেই গ্রামে যাবেন না। কারণ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তিকে মশায় কামড় দিলে সেই মশা ডেঙ্গ-সংক্রমিত হবে। ওই মশা অন্য কাউকে কামড় দিলে সেই ব্যক্তিও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হবে।
গ্রামে গিয়ে জ্বরে আক্রান্তদের উদ্দেশে মহাপরিচালক বলেন, জ্বর হলে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ঈদের দিন গ্রামগঞ্জে কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথকেয়ার প্রোভাইডাররা (সিএইচসিডি) অনকলে চিকিৎসা কাজে নিয়োজিত থাকবেন। স্থানীয় কোনো রোগীর যে কোনো সমস্যায় সিএইচসিপিদের মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করবেন। এ ছাড়া চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে মাঠ পর্যায়ে সার্বক্ষণিক মনিটরিং চালু থাকবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন এবং কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন নেই।
সার্বক্ষণিক মনিটরিং চালু থাকবে : ঈদের ছুটিতে গ্রামে গিয়ে কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তাদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে মাঠ পর্যায়ে সার্বক্ষণিক মনিটরিং চালু থাকার কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে হেল্পডেস্ক খোলা রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ঈদে গ্রামে যাওয়া মানুষের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে কমিউনিটি ক্লিনিককে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সব বিমান, নৌ ও স্থলবন্দরে ডেঙ্গু প্রতিরোধে বিশেষ সতর্কতা ও সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।