বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা ফৌজদারি মামলার তদন্তে বেশ অগ্রগতি রয়েছে। ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে দুর্ঘটনা পর্যন্ত কার কী দায়িত্বে অবহেলা ছিল তা বের করছে মামলার তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। রাজউক, ভবন মালিকপক্ষ এবং ডেভেলপার কোম্পানির ভূমিকা নিরূপণ করে তাদের গাফিলতি ও অপরাধের ধরন অনুযায়ী মামলার চার্জশিটে অভিযুক্ত করা হবে। তদন্ত সংস্থা বলছে, এই মামলার চার্জশিট হবে একটি ‘মাইলফলক’। দুর্ঘটনার ঘটনায় আগামীতে কোনো মামলা হলে যাতে তদন্তের ক্ষেত্রে এ মামলাটিকে উদাহরণ হিসেবে দেখাতে পারে; সেই লক্ষ্যে তদন্ত এগিয়ে চলছে। তবে মামলাটি চার্জশিট দাখিলের পর্যায়ে আসতে আরও বেশ কিছু দিন সময় লাগতে পারে।
এদিকে এফ আর টাওয়ারে দুর্ঘটনায় ফৌজদারি মামলার তদন্ত ছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ একাধিক সংস্থা তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেখানে উঠে এসেছে এফ আর টাওয়ার নির্মাণে পরতে পরতে গাফিলতি ছিল। ভবনটির অষ্টম তলায় ‘শর্টসার্কিট’ থেকে আগুন লেগেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে এ ধরনের দুর্ঘটনারোধে ২০টি সুপারিশ করা হয়।
গত ২৮ মার্চ দুপুরে বনানীর কামাল আতাতুর্ক সড়কের এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগে। এ ঘটনায় সর্বমোট ২৬ জন প্রাণ হারান। ঘটনার দিনই ২৫ জনের মৃত্যু হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরও একজন।
বনানী ট্র্যাজেডির পর সরকারের বিভিন্ন সংস্থা অন্তত ৫টি তদন্ত কমিটি গঠন করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কমিটি তার মধ্যে অন্যতম। ওই কমিটির প্রধান ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব তরুণ কান্তি শিকদার। এ ব্যাপারে তিনি সমকালকে বলেন, আগুন লাগার কারণ শর্টসার্কিট। ওই ভবন নির্মাণে নানা ধরনের অনিয়ম ছিল। সেখানে কার্যত কোনো ফায়ার এক্সিট ছিল না। যেটা ছিল নামকাওয়াস্তে। এমন দুর্ঘটনা রোধে কিছু সুপারিশও প্রতিবেদনে করা হয়েছে।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির উত্তর বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, দুর্ঘটনায় কার কী ভূমিকা ছিল তা উঠে আসবে। কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। এ মামলায় দাখিল করা চার্জশিট হবে একটি মাইলফলক।
ডিবির উত্তরের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার গোলাম সাকলায়েন বলেন, অগ্নিকাণ্ডে আহতদের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। ভবন নির্মাণ-সংক্রান্ত হাতে পাওয়া কাগজপত্র যাচাই-বাছাই পর্যায়ে রয়েছে।
তদন্ত সূত্র জানায়, বনানীর দুর্ঘটনার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ভূূমির মালিক প্রকৌশলী এস এম এইচ আই ফারুক হোসেন, এফ আর টাওয়ারের বর্ধিত অংশের মালিক কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সভাপতি ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তাসভির উল ইসলাম এবং রূপায়ণ গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান মুকুলকে আসামি করা হয়েছে। ফারুক ও তাসভিরকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। তবে রূপায়ণের চেয়ারম্যান মুকুলকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তাকে খুঁজছে ডিবি। অগ্নিকাণ্ডের পর দিন ২৯ মার্চ দুপুরে দেশ ছেড়েছেন তিনি। দেশে ফিরলেই তাকে গ্রেফতার করা হবে বলে জানায় পুলিশ। ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে এ ব্যাপারে তথ্য দেওয়া হয়েছে।
তদন্ত-সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, এফ আর টাওয়ারের ৪৫ শতাংশের মালিক জমির স্বত্বাধিকারী ফারুক। বাদ বাকি ৫৫ শতাংশের মালিকানা রূপায়ণ গ্রুপের। তবে রূপায়ণ গ্রুপ তাদের মালিকানায় থাকা একটি ফ্লোর ছাড়া অন্যগুলো বিক্রি করে দিয়েছিল। তবে ফারুক তার মালিকানাধীন ফ্লোরগুলো ভাড়া দিয়ে দেন। প্রথমে ওই ভবনের ১৮ তলা তৈরির অনুমোদন ছিল। পরে রূপায়ণ গ্রুপ আরও ৪টি ফ্লোর তৈরি করে। ওই সময় বাধা দেন ভূমির মালিক। বর্ধিত ফ্লোরের মধ্যে ১৯ তলাটি জমির মালিককে দিয়ে ২০, ২১ ও ২২ তলা রূপায়ণ গ্রুপ বিএনপি নেতা তাসভিরের কাছে বিক্রি করে দেয়।
এদিকে অগ্নিকাণ্ডের পর গঠিত একাধিক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে আসে- ভবনের ৮ তলা থেকে আগুনের সূত্রপাত। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য গ্লাসের যে দেয়াল ব্যবহার করা হয়েছে তা ভঙ্গুর ও অগ্নিনিরোধক নয়। ভবনটির প্রতিটি তলার ভেতরের নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে। রান্নাঘর ও টয়লেটের অবস্থান একেক তলায় একেক রকম। ৯ তলায় যেখানে টয়লেট ও রান্নাঘর, ৮ তলায় সেখানে অফিস কক্ষ। এতে অষ্টম তলার সিলিংয়ের ওপর পিভিসি পাইপ গলে ওপর তলায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে এবং আটতলা থেকেই আগুন শুরু হয়েছে। ঘটনার পর আটতলার মালিক সলিমুল্লাহ ও তার ছেলে আত্মগোপনে রয়েছেন।
তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, রূপায়ণের কাছ থেকে ভবনের মূল নকশা ডিবি সংগ্রহ করেছে। এছাড়া জমির মালিক ফারুক ও ২০, ২১, ২২ তলার মালিক তাসভির ভবন নির্মাণ-সংক্রান্ত কাগজপত্র দিয়েছেন ডিবিকে। নকশার অনুমোদন দেওয়া রাজউকের সেই সময়ের কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন গোয়েন্দারা। রাজউকে যাওয়ার জন্য ইতিমধ্যে আদালত থেকে অনুমোদন নিয়েছেন তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা। ২২ তলাবিশিষ্ট এফ আর টাওয়ারের এক্সিট সিঁড়ির দৈর্ঘ্য মাত্র ২৪ ইঞ্চি।
অগ্নিকাণ্ডের পর এফ আর টাওয়ারটি হেফাজতে নেয় পুলিশ। সার্বক্ষণিক পুলিশ পাহারায় রাখা হয় ভবনটি। তবে গত ২৪ এপ্রিল থেকে পুলিশ মালিক পক্ষের কাছে ভবন হস্তান্তর করেছে। এখন সেখানকার নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে এফ আর টাওয়ার ভবনের জমির মালিকের নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মীরা। অগ্নিকাণ্ডের পর ভবনের ভাড়াটে কিংবা বিভিন্ন ফ্লোরের মালিক পক্ষ তাদের মালপত্র স্থানান্তর শুরু করে। এখনও সব ফ্লোরের অফিস স্থানান্তরের কাজ শেষ হয়নি।
এফ আর টাওয়ারের জমির মালিক ফারুকের ম্যানেজার কামাল হোসেন বলেন, ভবন আমরা এখন ব্যবহার করতে পারব কী পারব না সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা পাইনি কোনো সংস্থা থেকে। এ নিয়ে আমরা অন্ধকারের মধ্যে আছি।
গত শুক্রবার দুপুরে এফ আর টাওয়ারে সরেজমিনে দেখা যায়, এক মাস আগেও যে ভবনে ছিল শত শত মানুষের আনাগোনা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মালিক-কর্মচারীর কর্ম ব্যস্ততা- সেটি এখন ঘুটঘুটে অন্ধকারে আচ্ছন্ন। বেশিরভাগ অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালপত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পরিত্যক্ত ভবনে পরিণত হয়েছে এফ আর টাওয়ার। এটির আশপাশের ভবনে কর্ম ব্যস্ততা স্বাভাবিক থাকলেও ২৮ মার্চের সেই ঘটনা ভুলতে পারেননি কেউই। ভবনে ঢোকার সামনের গেটটি তালাবদ্ধ। পেছনের গেট দিয়ে মালপত্র নামাচ্ছেন কয়েকজন শ্রমিক। সেখানে টিনের ছাউনির নিচে মালপত্র রাখা। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ১৫ তলার মাইকা নামের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আসবাবসহ কিছু প্রয়োজনীয় মালপত্র তারা নামিয়ে আনছেন। একই এলাকার আরেকটি ভবনে নতুন অফিস ভাড়া নিয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটি। একই দিনে ২০, ২১, ২২ তলার কাশেম গ্রুপের অফিসের মালপত্রও সরানো হচ্ছিল। এফ আর টাওয়ারের নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মীরা জানান, ৩, ১৪ ও ১৮ তলা জমির মালিক ফারুক হোসেন ভাড়া দেননি। ১৪ তলায় নিজের অফিস এবং ১৮ তলা ভাড়া দেওয়ার জন্য অগ্নিকাণ্ডের আগে সাজসজ্জা করেন। তিন তলায় কমিউনিটি সেন্টার। এই তিনটি ফ্লোরের মালপত্র সরানো হয়নি।
নিরাপত্তা কর্মী সেলিম রেজা বলেন, মালিকের তিনটি ফ্লোর বাদে প্রায় সব ফ্লোরের অফিস স্থানান্তর ও মালপত্র সরিয়ে নিয়েছেন সংশ্নিষ্টরা।