নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বরে প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁড়াখুঁড়ি চলছে কয়েক বছর ধরেই। বিভিন্ন সময়ে মিলেছে নানা ধরনের প্রাচীন প্রত্ন নিদর্শনও। তবে সর্বশেষ খননে এমন কিছু প্রাচীন বস্তুর সন্ধান পাওয়া গেছে, যেগুলো সম্পর্কে গবেষকরা দিয়েছেন চমকপ্রদ তথ্য।
উয়ারী-বটেশ্বরে খননকাজের প্রধান ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঢাকা অঞ্চলের প্রধান রাখী রায়ের ভাষ্য মতে, এসব নিদর্শন খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় শতকের। তবে ওই অঞ্চলে গড়ে ওঠা বসতিটি আরও পুরনো; তার ধারণা, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের।
২০০৩ সালে উয়ারী-বটেশ্বরের অসম রাজার গড়ের একটি ক্ষুদ্র অংশ (বটেশ্বর বাজারের কাছে), পরিত্যক্ত ভিটা (উয়ারি গ্রামের ভিতরগড়ের মাঝামাঝি) এলাকাকে সংরক্ষিত ঘোষণা করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।
চার মৌসুম খননের পর ২০১৬ সালে পরিত্যক্ত ভিটায় খনন শুরু করে অধিদপ্তর। সে খননকাজ শেষ হয়েছে এবছরই।
সম্প্রতি পরিত্যক্ত ভিটায় প্রথমবারের মতো স্তর বিন্যাসের কাজ শেষ করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, যেখানে মাটির নিচে ১৫টি স্তরে পাওয়া গেছে নানা প্রত্নবস্তু।
এসব প্রত্নবস্তুর সাংস্কৃতিক ইতিহাস বিচারের পর গবেষকরা বলছেন, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে এক অভিজাত শ্রেণির বসতি গড়ে উঠেছিল পরিত্যক্ত ভিটায়।
রাখী রায় বলেন, ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে সেখানে প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক স্তরায়ন উন্মোচিত হয়।
তিনি জানান, ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে খননে মূল্যবান পুঁতি, উত্তর ভারতীয় কালো-লাল মৃৎপাত্র ও তখনকার সময়ের নানা নিদর্শন পাওয়া গেছে।
কোন স্তরে মিলেছে কী
রাখী রায় জানান, খনন খাদের মাটির উপরিতল থেকে চার দশমিক এক মিটার গভীরতায় খনন চালান তারা। এভাবে খনন খাদের দক্ষিণ সেকশন বরাবর মোট ১৫টি স্তর চিহ্নিত করা হয়।
সাধারণত ঢিবি বা সঞ্চিত বালিময় এলাকা দেখে প্রত্নস্থল চিহ্নিত করা হলেও উয়ারিতে তার নিদর্শন পাওয়া যায়নি শুরুতে। পরে হুইলার-কেনিয়ন পদ্ধতিতে খনন শুরু হয়।
“একেকটি ট্রেঞ্চ খননের পর সেকশন ধরে ধরে কাজ এগিয়ে গেছে। স্তরগুলোতে ‘স্ট্যাটিসটিকাল মার্কিং’ করে প্রত্নবস্তুর ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে,” বলেন রাখী।
পনেরটি স্তরের মধ্যে ১০ সেন্টিমিটার পুরু প্রথম স্তরে পাওয়া যায় মৃৎপাত্রের টুকরো। পরে আরও ৫৭ সেন্টিমিটার পুরু দ্বিতীয় স্তর খননে লাল ও কালো পোড়া মাটির মৃৎপাত্র মেলে। সপ্তম স্তর পর্যন্ত পাওয়া যাওয়া ইটের কণা ও মৃৎপাত্রের নিদর্শন দেখে সেখানে মানবসভ্যতা বিকাশের তথ্য মেলে।
রাখী রায় বলেন, “প্রত্নবস্তুগুলোর মধ্যে আমরা যেসব পুঁতি পেয়েছি, ধারণা করছি সেগুলো খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের। সেখানে কোনো একটি সময়ে পুঁতির ব্যবসা বেশ জমজমাট ছিল বলে মনে হয়েছে। এছাড়া যেসব সাংস্কৃতিক নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো ইটনির্মিত কাঠামোর বসতবাড়ির নির্দেশনাই দেয়।”
এরপর অষ্টম স্তরে গিয়ে মেলে লোহাসমৃদ্ধ প্রাকৃতিক নুড়ি। নবম স্তর থেকে মাটির প্রকৃতি বদলাতে শুরু করে। সেখানে লোহাসমৃদ্ধ শক্ত মাটিতে লৌহযুগের কৃষ্ণ চিক্কণ মৃৎপাত্র, পোড়া লাল মৃৎপাত্রের নমুনা পাওয়া যায়।
একাদশ স্তরে এসে খ্রিস্টীপূর্ব তৃতীয় শতকের কিছু প্রত্নবস্তুর সন্ধান মেলে। দ্বাদশ স্তরে কালো আঠালো মাটিতে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের কৃষ্ণ চিক্কণ মৃৎপাত্র ও পোড়া লাল মৃৎপাত্রের নমুনা পান গবেষক দল। তাদের ধারণা, ওই সময়ই ওই এলাকায় মানব বসতি গড়ে উঠেছিল।
রাখী রায় জানান, গভীর খননে পাওয়া ১৫টি স্তরকে তারা তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথম (সবচেয়ে নিচের) থেকে দ্বাদশ স্তর পর্যন্ত মৃৎত্রের টুকরো, টালি, ইটের টুকরো, পুঁতি, ছাই, কয়লা মেলায় এ স্তরকে ‘সাংস্কৃতিক স্তর’ হিসেবে বর্ণনা করছেন তারা। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ স্তরকে ‘উদ্ভিজ্জের নিদর্শন সম্বলিত স্তর’ এবং পঞ্চদশ স্তরকে বলেছেন ‘প্রাকৃতিক স্তর’।
অষ্টম থেকে প্রথম স্তরে ইটনির্মিত কাঠামোর নিদর্শন পাওয়া গেছে। এসব স্তরে তিন সময়ের বসতির চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেছে।
আর ‘তোহর ক্ষেত’ প্রত্নস্থল খননে তিনটি খাদে চারটি স্তরে বসতির চিহ্ন পাওয়া গেছে। ঠিক কখন ওইসব বসতি স্থাপন হয়েছিল তা জানতে সেখানে পাওয়া উপাদানগুলোর কার্বন-১৪ পরীক্ষা করা হবে বলে গবেষকরা জানান।
উয়ারী-বটেশ্বরে উন্মোচিত ইটের কাঠামোর উপর আচ্ছাদন নির্মাণ করে প্রত্নবস্তুগুলো সেখানে প্রদর্শন করছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।
রাখী রায় জানান, অধিদপ্তরের রাজস্ব খাতের অর্থ দিয়ে সেখানে একটি ছোট জাদুঘর নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। জাদুঘরটির বিষয়ে এ বছরই কাজ শুরু করবেন বলে জানান তিনি।