‘এই বসন্তে অনেক বছর আগে, তোমায় প্রথম দেখেছিলেম আমি’ গানের ঠিক এই জায়গায় মন কেমন করে ওঠে। বসন্ত আর ভালোবাসা দুটো যেন একসঙ্গে জড়িয়ে থাকে। ঠিক যেমন একসঙ্গে জড়িয়ে যায় প্রেম ও দ্রোহ।
বিশ্বের প্রায় প্রতিটি সভ্যতারই বসন্তবরণের ইতিহাস রয়েছে। প্রাচীন গ্রিস ও রোমে বসন্ত উৎসব বেশ জোরে শোরে পালিত হতো। বলা হতো এ সময় পাখিরা জুটি বাঁধে। তরুণ তরুণীরা এদিন পরষ্পরকে ভালোবাসার কথা জানাতো।
প্রাচীন আর্যদের মধ্যেও বসন্ত পালনের রীতি ছিল। বাংলায় দোল উৎসব, রাসপূর্ণিমা মূলত বসন্ত বরণেরই উৎসব। দোল উপলক্ষ্যে আবির বা রং খেলার রীতি ছিল। বসন্ত বরণকে ধর্ম নিরপেক্ষ রূপ দিতে শান্তি নিকেতনে বসন্ত বরণের আয়োজন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ষাটের দশকে বাঙালি জাতীয় চেতনার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আবহমান কালের বসন্ত উৎসবকে নতুনভাবে শহুরে রূপে পালনের রীতি শুরু হয়।
পহেলা ফাল্গুনে হলুদ বা বাসন্তী রংয়ের শাড়ি পরার প্রচলন হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে বসন্ত বরণ বাঙালির জাতীয় ঐতিহ্যের অন্যতম প্রতীকে পরিণত হয়েছে ধীরে ধীরে।
সত্তর ও আশির দশকে পহেলা ফাল্গুনে নারীরা হলুদ, বাসন্তী, লাল বা সবুজ রংয়ের শাড়ি পরতেন। ফাল্গুনের বিশেষ শাড়ির প্রচলন হয় মূলত নব্বই দশকে। বেইলি রোডের শাড়ির দোকানগুলোতে প্রথম শুরু হয় ফাল্গুনের শাড়ি বিক্রির ধুম। সেই সঙ্গে ফুলের অলংকারের রীতিও নতুনভাবে শুরু হয়। তখন গাঁদা ফুলের মালা পরার রেওয়াজ ছিল। এখনকার মতো ফুলের মুকুটের চল ছিল না।
পহেলা ফাল্গুনে বাসন্তী পোশাক পরে বইমেলায় যাওয়ার রীতি নব্বই দশক থেকেই চলছে। আর চারুকলার বকুলতলায় বসন্ত বরণের উৎসবও বেশ ঐতিহ্যবাহী।
সেন্ট ভ্যালেনটাইনস ডে পাশ্চাত্যে প্রচলিত ছিল অনেক কাল ধরেই। যখন বাংলাদেশে সেন্ট ভ্যালেনটাইন’স ডের প্রচলন হয় নব্বইয়ের দশকে তখন বাঙালির কাছে এদিনটিকে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস নাম দিয়ে পরিচিত করানো হয়।
পাশ্চাত্যে এদিনটিতে প্রেমিক প্রেমিকারা পরষ্পরকে উপহার প্রদানের মাধ্যমে ভালোবাসা প্রকাশ করে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুসরণে ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, সৌদি আরব, মালোয়েশিয়াসহ এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এ দিনটি ভালোবাসা প্রকাশের দিন হিসেবে পালন করা হয়। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় বিভিন্ন উৎসব ও রীতি রেওয়াজের মধ্য দিয়ে প্রেমিক প্রেমিকারা দিনটি পালনকরেন।
ভ্যালেনটাইনস ডে-এর ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন পণ্ডিতের ভিন্ন ভিন্ন অভিমত। তবে অধিকাংশ পণ্ডিতের মতে রোমের সেন্ট ভ্যালেনটাইনের নামানুসারে এই দিবসের নামকরণ হয়েছে।
প্রচলিত মত অনুসারে ২৬৯ সালে রোমে ভ্যালেনটাইন নামে একজন সাধু ছিলেন। সেটি ছিল রোমান সম্রাট ক্রাডিয়াসের শাসনকাল। তখন খ্রিস্টধর্মের প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। রোম সম্রাট তার সৈন্যদের বিয়ে করতে নিষেধ করেন কারণ তাহলে তারা মন দিয়ে যুদ্ধ করতে পারবে না।
সম্রাটের এই অমানবিক আদেশকে মেনে নেননি সাধু ভ্যালেনটাইন। তিনি গোপনে প্রেমিক প্রেমিকাদের বিয়েতে পৌরহিত্য করতেন মতান্তরে তাদের খ্রিস্ট ধর্মেও দীক্ষিত করতেন।
সম্রাট ভ্যালেনটাইনকে কারাবন্দী করেন। বন্দী ভ্যালেনটাইন কারাপ্রধানের দৃষ্টিহীন কন্যা জুলিয়াকে আরোগ্য করেন। দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায় জুলিয়া।
এদিকে ভ্যালেনটাইনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হয়। মৃত্যুর আগে সেন্ট ভ্যালেনটাইন জুলিয়ার উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে যান। চিঠির শেষে তিনি লেখেন ‘ফ্রম ইয়োর ভ্যালেনটাইন’।
পরবর্তি কালে রোমে খ্রিস্ট ধর্মের প্রসারের পর সেন্ট ভ্যালেনটাইনের শহীদ হওয়ার দিনটি পালিত হতে থাকে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে।
১৪শ’ শতকে ইংরেজ সাহিত্যিক চসারের লেখায় ভ্যালেনটাইনস ডে’র সঙ্গে রোমান্টিক আবহ যুক্ত হয় এবং এটি প্রেমিক-প্রেমিকার দিবস হিসেবে পালিত হওয়া শুরু হয়।
অনেক পণ্ডিতের মতে ফেব্রুয়ারি মাসে উদযাপিত প্রাচীন গ্রেকো-রোমান ঐতিহ্যের প্রেম-প্রস্তাব দিবস লুপার সালিয়ার রীতি রেওয়াজ- এই দিবসে অঙ্গীভূত হযেছে। তবে এই দাবির কোন বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
মধ্যযুগে ঊনবিংশ শতকে ইউরোপে ভ্যালেনটাইন দিবসে প্রিয়জনকে চিঠি, কার্ড, উপহার এবং মিষ্টিজাতীয় সামগ্রী প্রদানের রেওয়াজ চালু হয়। প্রেমিকাকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য দিনটি প্রসিদ্ধি লাভ করে।
ভ্যালেনটাইনস ডে’র প্রতীক হলো এমেথিস্ট পাথর, হৃদয়আকৃতি, লাল গোলাপ, কিউপিড ইত্যাদি। কথিত আছে সেন্ট ভ্যালেনটাইনের হাতে অ্যামেথিস্ট পাথর বসানো একটি আংটি ছিল এবং এই পাথর ভালোবাসা লাভে সাহায্য করে।
আমেরিকায় বিগত পঞ্চাশ দশক ধরে দিনটির বাণিজ্যিক গুরুত্ব ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। উপহার আদান প্রদানের দিক থেকে ক্রিসমাসের পরই গুরুত্ববহ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভ্যালেনটাইনস ডে।
বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশক থেকে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস নামে ১৪ ফেব্রুয়ারির দিনটি উদযাপিত হতে থাকে। ১৩ ফেব্রুয়ারি পহেলা ফাল্গুনের বসন্ত বরণ এবং ১৪ ফেব্রুয়ারিতে ভালোবাসা দিবস পালনের রীতি চলে আসছে প্রায় ২৫ বছর ধরে। দুটি দিনেই এই দিবসে প্রচুর সংখ্যক গোলাপ ও ফুলের মুকুট বিক্রি হতে দেখা গেছে।
চারুকলায় বসন্ত বরণের উৎসব আর ভ্যালেনটাইন’স ডে উপলক্ষ্যে ঢাকার শাহবাগ এলাকা, রমনাপার্ক ও ধানমণ্ডি লেক পরিণত হয় তরুণ তরুণীদের মিলনমেলায়।
এই বছরের বিশেষ তাৎপর্য পহেলা ফাল্গুন ও ভ্যালেন্টাইন- ১৪ ফেব্রুয়ারিতে পড়েছে। ফলে দুটি দিনই উদযাপিত হচ্ছে একই সঙ্গে।
বসন্তবরণ বাঙালির চিরন্তন ঐতিহ্য আর ভ্যালেনটাইন’স ডে বিশ্ব সংস্কৃতির অংশ। হলুদ, লাল পোশাক সঙ্গে ফুলের মালা ও মুকুট দিনটিকে একই সঙ্গে উদযাপন করার অনুষঙ্গ হতে পারে সহজেই।
বসন্ত মূলত তারুণ্য ও প্রেমেরই জয়গান গায়। তাই দুটি দিন একসঙ্গে উদযাপনে কোনো বাধা নেই মোটেই। সকলের জীবন বসন্তে সজীব ও ভালোবাসায় ঋদ্ধ হোক এমন শুভ কামনা জানাতে পারেন নিশ্চয়ই।