জামায়াতে ইসলামীর নীতিনির্ধারকরা নতুন নামে যে দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন, তাতে নেতৃত্বে থাকবেন স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্মের নেতারা। জামায়াতের মতো শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থাকবে না দলটির। ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাস হবে দলটির ‘ভিত্তি’। স্লোগান হবে সামাজিক ন্যায়বিচার। জামায়াত আর ভোটের রাজনীতিতে থাকবে না। নতুন দল গঠিত হলেও জামায়াত বিলুপ্ত হবে না; বরং আড়াল থেকে নতুন দলকে নিয়ন্ত্রণ করবে। ফলে একাত্তরের ভূমিকা তাদেরকে তাড়া করে যাবেই। এ নিয়ে তারা বেশ গ্যাঁড়াকলেই পড়েছে। দলের ভেতরে চলছে অস্থিরতা।
একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার জন্য ক্ষমা চেয়ে জামায়াত বিলুপ্ত করে মধ্যডানপন্থি দল গঠনের প্রস্তাব করেছিলেন দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। তার প্রস্তাব গ্রহণ না করায় গত ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি জামায়াত থেকে পদত্যাগ করেন। একই দাবি জানানোর কারণে জামায়াত থেকে সেদিনই বহিস্কৃত হন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু। তাদের পদত্যাগ ও বহিস্কার নতুন আলোচনা সৃষ্টি করেছে রাজনীতিতে।
দলটির নেতাকর্মীরা সংস্কারের পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সংস্কারের পক্ষে-বিপক্ষে লিখছেন। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্র থেকে জেলা ও মহানগর শাখাগুলোতে দেওয়া নির্দেশনামূলক চিঠিতে জানানো হয়, নতুন দল গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি কাজ শুরু করেছে।
এ কমিটির সদস্য জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ সদস্য ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের। তিনি জানান, এ বিষয়ে গণমাধ্যমে মন্তব্য করার সুযোগ নেই। তিনি বলেছেন, দলের বিভিন্ন ফোরাম থেকে নানা রকম প্রস্তাব এসেছে। দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা এগুলো বিচার-বিশ্নেষণ করছেন।
জামায়াত সূত্রে জানা যায়, নতুন নামে দল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কোণঠাসা অবস্থা থেকে উত্তরণ, ‘সরকারের দমনপীড়ন থেকে রক্ষা’ এবং ভবিষ্যতের রাজনীতির কথা ভেবে। দলটির তাত্ত্বিক নেতাদের বিশ্নেষণ, সরকারের অব্যাহত চাপ, খালেদা জিয়ার সাজা এবং তারেক রহমানের নির্বাসনে বিএনপির ভবিষ্যৎ বিপদে। বিএনপি দুর্বল হলে আওয়ামী লীগবিরোধী মনোভাবের ভোটারদের ‘প্ল্যাটফর্ম’ থাকবে না। বিএনপি ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়লেও একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার কারণে আওয়ামীবিরোধী সাধারণ ভোটাররা জামায়াতের দিকেও ভিড়ছে না। একই কারণে ভারতবিরোধীদেরও কাছে পাচ্ছে না জামায়াত। বিএনপি দুর্বল হলে আওয়ামী লীগ ও ভারতবিরোধীদের ‘আবশ্যিক গন্তব্য’ হতে একটি তুলনামূলক উদার রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন জামায়াতের তাত্ত্বিক নেতারা।
তবে জামায়াতের নতুন দল কেমন হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। দলটির একেক সূত্র একেক রকম তথ্য দিয়েছে। কবে নাগাদ নতুন দল গঠিত হতে পারে, তাও নিশ্চিত নয়। তবে একাধিক সূত্র জানায়, শিগগিরই নতুন দলের আত্মপ্রকাশের সম্ভাবনা নেই। দল গঠনে সময় লাগবে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ নতুন দল রাজনীতির মাঠে আসতে পারে।
জামায়াত সূত্র জানায়, নতুন দলের সভাপতি হতে পারেন ডা. শফিকুর রহমান। নতুন দলে আমির, সেক্রেটারি জেনারেল নামে পদ থাকবে না। পদগুলোর নাম হবে বাংলায়। সাধারণ সম্পাদক পদে আসতে পারেন রফিকুল ইসলাম খান। তারা দু’জনই স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্মের নেতা। নতুন দল হলেও জামায়াত বিলুপ্ত হবে না। প্রবীণ নেতাদের নতুন দলের নেতৃত্বে আনা হবে না। তারা জামায়াতেই থাকবেন।
নতুন দলের জন্য কয়েকটি নাম প্রস্তাবনায় রয়েছে। নতুন দলের নামে ‘ইসলাম’ শব্দটি না থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি)’, ‘বাংলাদেশ জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিজেডিপি)’সহ কয়েকটি নাম রয়েছে আলোচনায়।
তুরস্কে ইসলামপন্থি দল ভার্চু পার্টি ছেড়ে রিসেপ তায়েপ এরদোয়ানের নেতৃত্বে ২০০১ সালে জাস্টিজ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (একে) পার্টি গঠিত হয়। মধ্যডানপন্থি এ দলটি ২০০২ সাল থেকে তুরস্কে ক্ষমতায়। ১৯৮১ সালে তিউনিসিয়ায় রশিদ ঘানুশির নেতৃত্বে গঠিত হয় এন্নাহাদা মুভমেন্ট। মরক্কোতে ক্ষমতাসীন পিজেডিও একই ধারায় বিশ্বাসী। এ দলগুলোর নেতারা একটি সময়ে রক্ষণশীল সংগঠন ‘মুসলিম ব্রাদারহুডে’র ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। পরবর্তী সময়ে উদারপন্থি ইসলামী দল গঠন করে ভোটের রাজনীতিতে সাফল্য পেয়েছেন।
আবদুর রাজ্জাক বলেন, তার প্রস্তাব ছিল জামায়াতও একটি উদার ও মধ্যডানপন্থি দল গড়ে তুলুক। তবে যুদ্ধাপরাধের বিচারে কোণঠাসা হয়ে ধরপাকড়ের মুখে থাকা নিবন্ধন হারানো জামায়াত এতে রাজি নয় বলে জানিয়েছে দলটির সূত্র। নয় বছর ধরেই জামায়াতের কার্যক্রম নিষিদ্ধ দলের মতো চললেও দলটির কট্টরপন্থিরা নীতি পরিবর্তনে রাজি নন। মজিবুর রহমান মঞ্জু নিয়েছেন, জামায়াতের তরুণ নেতাকর্মীরা সংস্কারের জন্য উদগ্রীব। তারা সংস্কার চান।
রক্ষণশীল নেতারা নতুন দল গঠনের সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও তারা চান, জামায়াতের আদলে আরেকটি দল। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ সদস্য মুহাম্মদ সেলিম সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত মতিউর রহমান নিজামীর ‘ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠন’ বই থেকে লিখেন, ‘মানুষের পক্ষে মতামত কোরবানি দেওয়াটাই বড় কোরবানি। …হাজার কিংবা একশ’ মতের ভিত্তিতে কোনোদিন আন্দোলন ও সংগঠন চলতে পারে না। সংগঠনকে একটা মতের ওপর এসেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠার পর জামায়াত ‘ইসলামী শরিয়া রাষ্ট্রের’ দাবি নিয়ে রাজনীতির মাঠে রয়েছে। দলটির স্লোগান ‘আল্লাহর আইন চাই, সৎ লোকের শাসন চাই’। জামায়াতের গঠনতন্ত্রে জনগণের সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। দলটির ২(৫) ধারায় বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহাকেও বাদশাহ, রাজাধিরাজ ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মানিয়া লইবে না, কাহাকেও নিজস্বভাবে আদেশ ও নিষেধ করিবার অধিকারী মনে করিবে না।’
জামায়াত নতুন নামে যে দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে, তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য শরিয়া নয়, থাকবে ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’। জামায়াতের রাজনীতির পর্যবেক্ষক সাবেক সচিব শাহ আবদুল হান্নান বলেন, ‘জামায়াতের বিলুপ্তির প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এরপরও জামায়াত হয়তো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসতে পারে। ইসলামের প্রচার ও সমাজকল্যাণমূলক কাজ দলের নতুন ফোকাস হতে পারে। আর কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি নিয়ে ভিন্ন কোনো রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।’
দলীয় সূত্র জানিয়েছে, জামায়াত আর ভোটের রাজনীতিতে থাকবে না। দলের গঠনতন্ত্রের ৬(৪) ধারা স্থগিত করা হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে, ‘গণতান্ত্রিক পন্থায় সরকার পরিবর্তন এবং সমাজের সর্বস্তরের সৎ ও চরিত্রবান লোকের নেতৃত্ব কায়েমের চেষ্টা করা।’ দলীয় সূত্র জানিয়েছে, নতুন দল গঠিত হলে সামাজিক সংগঠন হিসেবে কাজ করবে জামায়াত। ইসলামের দাওয়াত, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কাজ এবং দাতব্য কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ থাকবে দলটি।
জামায়াত ভোট থেকে সরে গেলেও নতুন দলের ওপর তাদেরই নিয়ন্ত্রণ থাকবে। দলটির সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) ভোটের রাজনীতিতে না থাকলেও দেশটির ক্ষমতাসীন দল বিজেপির নিয়ন্ত্রক তারাই। আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেয় বিজেপি। নতুন দল হবে জামায়াতের রাজনৈতিক শাখা মাত্র। আবদুর রাজ্জাক এবং তার অনুসারীরা এ ধারণার বিরোধী বলে জানিয়েছে জামায়াত সূত্র। তাদের অভিমত, জামায়াতের সংশ্নিষ্টতা রেখে নতুন দল করে কোনো লাভ হবে না; বরং নতুন দলও বিতর্কিত হবে। ‘সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম’ নতুন দলকে ‘নেতিবাচক’ হিসেবে তুলে ধরবে। তাই জামায়াত বিলুপ্ত করেই নতুন দল করা উচিত।
স্বাধীনতার পর নিষিদ্ধ হয় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা জামায়াত। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সাজা হয়েছে। আদালতের রায়ে জামায়াতকে অপরাধী দল বলা হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ঠেকাতে গিয়ে জামায়াতের কর্মসূচিতে সহিংসতায় দলটির পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। সহিংসতার মামলায় দলটির লাখখানেক নেতা মামলার আসামি হয়ে হয় কারাগারে গিয়েছেন, নয়তো আত্মগোপনে রয়েছেন। ২০১১ সাল থেকেই সারাদেশে জামায়াতের অধিকাংশ কার্যালয় বন্ধ।
জামায়াতের সংস্কার নিয়ে ১৯৭৯ সাল থেকেই বিরোধ চলছে। ১৯৭৭ সালে ধর্মভিত্তিক দল গঠনে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর জামায়াত নেতারা মাওলানা আবদুর রহিমের নেতৃত্বের ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) গঠন করেন। স্বাধীনতা-বিরোধিতাকারীদের অন্যতম নেতা গোলাম আযম দেশে ফিরে ১৯৭৯ সালে জামায়াত পুনরুজ্জীবিত করেন। দলচ্যুত হন সংস্কারের দাবি করা আবদুর রহিম। সংস্কারের দাবিতে ১৯৮১ সালে ফের জামায়াত ও শিবিরে অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল। সংস্কারের দাবিকারীদের সেবারও দলছাড়া করা হয়েছিল।
২০০৭ সালে ফের জামায়াতে সংস্কারের দাবি আসে। ২০১০ সালে কামারুজ্জামান, আবদুর রাজ্জাক ও মীর কাসেম আলী সংস্কারের প্রস্তাব করলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। সেবারও সংস্কারের জন্য কমিটি হয়। তবে মতিউর রহমান নিজামীসহ রক্ষণশীল নেতাদের বিরোধিতায় সে উদ্যোগ ভেস্তে যায়। একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা না চাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে জামায়াত। এখনও তাই রয়েছে।