এখন সময় খোঁড়াখুঁড়ির !

Untitled-11-5cae564ea24b2

খোঁড়াখুঁড়ির ভোগান্তি থেকে নিস্তার নেই নগরবাসীর। বছরজুড়ে এটা চললেও বর্ষা মৌসুমের আগে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এ ছাড়াও বর্তমানে রাজধানীতে চলছে মেট্রো রেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজ। এসব কারণেও চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। ফলে অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার নতুন মাত্রা পেয়েছে। এদিকে বর্ষা মৌসুম না এলেও মাঝে মধ্যেই রাজধানীতে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। খোঁড়াখুঁড়ির সঙ্গে বৃষ্টিপাত যুক্ত হয়ে ভোগান্তি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। নগরবাসীর নাভিশ্বাস। অথচ এ ভোগান্তি লাঘব করতে দুই বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সমন্বয়ের মাধ্যমে রাজধানীর উন্নয়ন পরিচালনার জন্য একটি পরিপত্র জারি করা হয়েছিল। খুব একটা ফল বয়ে আনেনি সেটাও।

নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আখতার মাহমুদ বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরেই দেখে আসছি প্রতি বছর জুনের আগের মাসগুলোতে রাজধানীতে ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়ে যায়। এর কারণ হলো জুন মাসে অর্থবছর শেষ হয়। এ সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা বা অর্থ ব্যয় করার একটি বাধ্যবাধকতা থাকে। এ জন্য এ সময় খোঁড়াখুঁড়ি বেশি থাকে। এসব খোঁড়াখুঁড়ির যারা কর্তৃপক্ষ, তাদের উচিত হবে বর্ষা মৌসুমকে পাশ কাটিয়ে বছরের শুরুতেই কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা। শুধু পরিকল্পনা করলেই হবে না, তা বাস্তবায়নও করতে হবে।’

তিনি বলেন, ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি পরিপত্র জারি করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল-

সিটি করপোরেশনের মেয়রের সভাপতিত্বে সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয় সভা হবে। তবে সমন্বয় সভাটা নিয়মিত হয় না। এটা হলে শহরের পুরো উন্নয়ন কাজ একটা রোডম্যাপের মধ্যে চলে আসে। অনেক সময়ই দেখা যায়, সেই সমন্বয় সভায় সেবা সংস্থার প্রধানরা যোগ দেন না। তারা প্রতিনিধি হিসেবে সাধারণ কর্মকর্তাদের পাঠান। ফলে মাঝে মধ্যে সভা হলেও সেটা ফলপ্রসূ হয় না। সমন্বয় সভার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানপ্রধানের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করতে হবে। তাহলে কিছুটা ফল পাওয়া যেতে পারে। স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘কেবল পরিপত্র জারি করে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব না। এ জন্য সব সেবা সংস্থাকে একটি ছাতার নিচে আনতে হবে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে এভাবেই হয়। নগরীর সকল উন্নয়ন কাজ একটি সংস্থার অধীনে পরিচালিত হয়। যেটাকে বলা হয় সিটি গভর্নমেন্ট। তবে বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম। যতদিন পর্যন্ত আমরা একটা ছাতার নিচে সব সেবা সংস্থাকে আনতে না পারব, ততদিন এই সমস্যা চলতেই থাকবে।’

সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সমন্বয়হীনতার কারণে একই রাস্তায় বারবার খোঁড়াখুঁড়ির ঘটনা ঘটে। একটি সংস্থা কাজ শেষ করার কিছু দিন পরই আরেক সংস্থা আবার কাটতে শুরু করে। ফলে সিটি করপোরেশন রাস্তার আধুনিকায়ন করলেও সেই রাস্তা বেশি দিন নিখুঁত থাকে না। এ জন্যই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পরিপত্র জারি করা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল- কোনো রাস্তা কাটতে হলে সিটি করপোরেশন থেকে অনুমতি নিতে হবে। তবে সেটা তেমন অনুসরণ করা হচ্ছে না।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ কুদরতুল্লাহ বলেন, বেশ কিছু দিন আগে ঢাকা ওয়াসা মিরপুরের একটি রাস্তা কাটার জন্য আবেদন করে। রাস্তাটি আধুনিকায়নের পরপরই আবেদনটি আসে। এ অবস্থায় কাটার অনুমতি দিলে রাস্তাটি আবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ জন্য সিটি করপোরেশন ওই রাস্তা কাটার অনুমতি দেয়নি। অথচ ক’দিন পরই তারা রাস্তা কাটা শুরু করে। তখন সিটি করপোরেশন জানতে চাইলে ওয়াসা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একটি অনুমতিপত্র দেখায়।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘একটি রাস্তা সুন্দর করে কার্পেটিং করে দেওয়ার শর্তে অন্য সেবা সংস্থাগুলোকে রাস্তা কাটার অনুমতি দেওয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ওই সংস্থার কাজ শেষ হওয়ার পর তারা মেরামতটা ঠিকমতো করে না। সেখানে ইট-সুড়কি-বালু ফেলে যায়। ভালো রাস্তা কাটার পর যতই মেরামত করা হোক, আগের রূপে ফিরে আসে না। তখন ধীরে ধীরে ক্ষতের পরিধি বাড়তে থাকে। ভালো রাস্তাটি দ্রুতই নষ্ট হয়ে যায়।’

জানা যায়, সিটি করপোরেশন অসময়ে রাস্তা কাটার অনুমতি না দিলেও অনেক সময় অন্য সংস্থাগুলো প্রভাব খাটিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে নেয়। তখন সিটি করপোরেশনেরও তেমন কিছু করার থাকে না। ফলে সমন্বয়ের যে পরিপত্র প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জারি করা হয়েছিল, তা খুব একটা কাজে আসেনি। একই রাস্তা বছরে চার-পাঁচবার খোঁড়াখুঁড়ির নজিরও সৃষ্টি হয়েছে। মার্চ মাস থেকেই কম-বেশি বৃষ্টিপাত শুরু হয়। খোঁড়াখুঁড়ির সঙ্গে বৃষ্টির পানি মিলেমিশে ওই সব সড়কে চলাচল করাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সিটি করপোরেশনের যত কাজ আছে সেগুলো আগামী ৩০ এপ্রিলের মধ্যে শেষ করতে হবে। ওই সময়ের পর আর কোনো কাজ করা যাবে না। পাশাপাশি এখন থেকে বর্ষা মৌসুম শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর কোনো সংস্থাকে রোড কাটার অনুমতি দেওয়া হবে না। কারণ, সামনে শুধু বর্ষা মৌসুমই না, রমজানও আছে।’ তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জারি করা পরিপত্রটা তারা কার্যকর করার চেষ্টা করছেন। এক্ষেত্রে অন্য সেবা সংস্থাকেও এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর কার্যালয়ের আদেশ প্রতিটা সংস্থাকেই গুরুত্ব দিয়ে পালন করা উচিত।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, পরিপত্র জারির পর কিছুটা ফল পাওয়া গেছে। তারা নিয়মিত বৈঠকও করছেন। অন্য সেবা সংস্থাগুলোকে এ ব্যাপারে বারবার হুঁশিয়ারিও করছেন। তারা সব সময় চেষ্টা করছেন বর্ষা মৌসুমের আগেই কাজ শেষ করতে। রোড কাটার অনুমতি এসব ভেবেই দেওয়া হয়। বর্তমানে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া রোড কাটার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।

জানা গেছে, রাজধানীতে যেসব সেবা সংস্থা সবচেয়ে বেশি খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করে তার মধ্যে দুই সিটি করপোরেশন, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি, ডিপিডিসি, ডেসকো, পিডিবি, পিজিসিবি ও বিটিসিএল অন্যতম।

ঢাকা ওয়াসার বিরুদ্ধে অসময়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির সবচেয়ে বেশি অভিযোগ পাওয়া যায়। সম্প্রতি এ ব্যাপারে ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী কামরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলতে তার কার্যালয়ে গেলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। সংস্থার পরিচালক এ কে এম শহিদ উদ্দিনও কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান তো দেখাই দেননি।

সরেজমিন চিত্র :রাজধানীর মগবাজার চৌরাস্তা থেকে মধুবাগ পর্যন্ত সড়কটি প্রায় দেড় মাস আগে কেটেকুটে তছনছ করে রাখা হয়েছে। সেখানে বসানো হচ্ছে ওয়াসার পাইপ ড্রেন। এই কাজ করতে এমনভাবে খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়েছে, ওই পথ দিয়ে যান চলাচলের কোনো উপায় নেই। এত বিশ্রীভাবে মাটিকাদা ও ইট-সুড়কির স্তূপ করে রাখা হয়েছে পথচারীরাও চলতে পারেন না। ম্যানহোলের ঢাকনাগুলো খোলা। বৃষ্টি হলেই পুরো সড়ক কাদা-পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। একে ‘ভয়ঙ্কর অবস্থা’ বলে মন্তব্য করেন বড় মগবাজারের গৃহবধূ নিশাত সাবেরা। তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘মেয়েকে নিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যেতে হয়। বাসা থেকে মগবাজার চৌরাস্তা পর্যন্ত যাওয়া যে কী কষ্টকর, বলে বোঝানো যাবে না।’

কেবল এই সড়কটিই নয়। বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চলছে খোঁড়াখুঁড়ির মহোৎসব। আবার মগবাজার এলাকায় খোঁড়াখুঁড়ি জালের মতো বিস্তৃত। ইস্কাটন রোড সংলগ্ন দিলু রোডের শুরু থেকে বারাকাহ জেনারেল হাসপাতাল পর্যন্ত পুরো সড়কটির চিত্রও একই রকম। প্রায় মাসখানেক ধরে সেখানে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। মগবাজারের গাবতলা ও শাহ সাববাড়ির মাজার এলাকায়ও একই অবস্থা। ইস্কাটন রোডের মহিষপাড়া বস্তি এলাকায় হাতিরঝিলের পাশ ঘেঁষে বড় বড় পাইপ ফেলে রাখা হয়েছে। দিলু রোড দিয়ে হাতিরঝিলে যাওয়ার সড়কটিও কাটা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কাকরাইল গির্জা থেকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ইনস্টিটিউটের সামনে দিয়ে মৎস্য ভবন পর্যন্ত খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়েছে। সেখানে স্ট্রেন্সলেস পদ্ধতিতে চলছে পাইপ স্থাপনের কাজ। সেগুনবাগিচা এলাকার ভেতর দিয়ে প্রায় সব রাস্তা খুঁড়ে তছনছ করা হয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্যান্টিন থেকে কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স সড়কে। সড়কের একপাশ প্রায় চার-পাঁচ ফুট গভীর করে খুঁড়ে রাখা হয়েছে। এ পথ দিয়েও যান চলাচল করা দুঃসাধ্য। নিকুঞ্জ এলাকায় ওয়াসার পাইপড্রেন স্থাপনের কাজ চলছে। অফিসার্স ক্লাবের সামনে পূর্বপাশের ফুটপাতে দেখা গেছে মোটা মোটা পাইপের স্তূপ। পাইপগুলো বসানোর জন্য এই সড়কটিও হয়তো খুব শিগগিরই খোড়া হবে বলে এলাকাবাসী জানান।

একই চিত্র দেখা গেছে বাসাবো নন্দীপাড়া সড়কেও। এই সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে প্রায় এক বছর ধরে। সেখানে মাটি খুঁড়ে পাইপড্রেন বসিয়ে নতুন রাস্তা তৈরির কাজ চলছে। ফলে পুরো রাস্তাই এমনভাবে খোঁড়া হয় যে ওই রাস্তা দিয়ে চলাচলের উপায় নেই। এখনও সেই কাজ শেষ হয়নি।

নগরজুড়ে এই খোঁড়াখুঁড়ির ফলে রাস্তাগুলোও বেহাল হয়ে পড়ছে। মধ্য বাসাবোর বাসিন্দা জামাল উদ্দিন বলেন, ‘এই সড়ক দিয়ে রাজধানীর পূর্বাঞ্চলের অনেক মানুষ ঢাকায় প্রবেশ করে। অথচ সড়কটি চলাচলের উপযোগী না থাকায় এক বছর ধরে অন্তত ১০ লাখ মানুষ ভোগান্তিতে আছেন। কবে যে এই ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবেন, তার ঠিক নেই। এলাকাবাসীর নাভিশ্বাস উঠেছে। ইউসুফ হোসেন নামের এক রিকশাচালক জানান, আগে তিনি ওই সড়কে রিকশা চালাতেন। এখন এদিকে রিকশা চালানোই বন্ধ করে দিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন সেবা সংস্থার ঠিকাদারি কাজের সঙ্গে যুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসএম কনস্ট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী হাসিবুর রহমান শাহিন বলেন, কোনো কার্যাদেশ দেওয়ার সময় কাজটি কতদিনের মধ্যে শেষ হবে, সেটা উল্লেখ করা হয়। তবে ঠিকাদাররা সব সময় তা মানেন না। এ জন্য প্রতিটি সাইটে কাজ শেষ করার তারিখ সংবলিত একটি সাইনবোর্ড লাগানো দরকার। তাহলে জনগণও জানতে পারবে কবে কাজ শুরু হয়েছে, কবে শেষ হবে। ঠিকাদারের ওপরও চাপ তৈরি হবে।

তিনি জানান, আনিসুল হক মেয়র থাকাকালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এভাবে কয়েকটি উন্নয়ন কাজ করেছেন। সেখানে কাজ শুরু ও শেষ করার তারিখ দিয়ে ডিজিটাল বোর্ড বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাতে সুফলও পাওয়া গেছে।

Pin It