অভিনব ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে এটিএম বুথের ‘সিস্টেম হ্যাক’ করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে ডাচ-বাংলা ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে।
তিন দিন আগে ওই ঘটনায় রাজধানীর বাড্ডায় ডাচ-বাংলা ব্যাংকের একটি এটিএম বুথ থেকে তিন লাখ টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়। অথচ ব্যাংকের মূল সার্ভারে ওই লেনদেনের কোনো রেকর্ড নেই। কোনো গ্রাহকের হিসাব থেকেও টাকা কমেনি।
ওই ঘটনার পরদিনই খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের সামনে ডাচ বাংলা ব্যাংকের আরেকটি বুথ থেকে টাকা তোলার সময় এক বিদেশি নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পান্থপথের একটি হোটেল থেকে গ্রেপ্তার করা হয় আরও পাঁচ বিদেশিকে।
ওই ছয়জনের সবাই ইউক্রেনের নাগরিক। তাদের আরেক সহযোগী সেদিন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় বলে পুলিশের ভাষ্য।
ডাচ বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন সোমবার বলেন, “আমরা যদি তাদের ধরতে না পারতাম, তাহলে তারা অনেক বড় ক্ষতি করতে পারত। কারণ তারা এমনভাবে টাকা নিয়েছে এটার বিষয়ে ধরতে পারা খুব কঠিন।”
বাড্ডার ওই বুথের সিসিটিভি ভিডিওতে দেখা যায়, ৩১ মে রাত সাড়ে ১১টার দিকে দুই বিদেশি নাগরিক ওই বুথে ঢোকেন এবং একটি কার্ড ব্যবহার করে বেশ কয়েকবার টাকা তোলেন।
সে সময় বুথের ভেতর নিরাপত্তাকর্মীও উপস্থিতি ছিলেন। টাকা তোলার সময় তারা চোখে সানগ্লাস আর মাথায় ছিল টুপি পরে, মুখ ঢেকে পরিচয় গোপন রাখার চেষ্টা করেন।
এর আগে গ্রাহকের কার্ডের তথ্য চুরি করে ক্লোন কার্ড বানিয়ে এটিএম বুথ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটলেও এভাবে মূল সার্ভারকে অন্ধকারে রেখে কোনো নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্ট থেকে না নিয়ে বুথ থেকে টাকা বের করার ঘটনা বাংলাদেশে জানা গেল এই প্রথম।
এ ঘটনায় রোববার খিলগাঁও থানায় একটি মামলা দায়ের করেন ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ডেলিভারি চ্যানেলের হেড অব অলটারনেট মশিউর রহমান। মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় গোয়েন্দা পুলিশকে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা ওই মামলায় বলা হয়, ‘দেশি-বিদেশি জালিয়াতদের‘ ওই সংঘবদ্ধ চক্রটি খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের সামনের ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথসহ অন্যান্য বুথের ‘সিস্টেম হ্যাক করে’ টাকা উত্তোলন করছে।
গ্রেপ্তার ছয়জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ইতোমধ্যে তিন দিনের রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ। এরা হলেন- দেনিস ভিতোমস্কি (২০), নাজারি ভজনোক (১৯), ভালেনতিন সোকোলোভস্কি (৩৭), সের্গেই উইক্রাইনেৎস (৩৩), শেভচুক আলেগ (৪৬) ও ভালোদিমির ত্রিশেনস্কি (৩৭)
তাদের কাছ থেকে ৫০টি কার্ড, মুখোশ, টুপি, সানগ্লাস, মোবাইল ফোন ও আইপ্যাড জব্দ করার কথা জানিয়েছে পুলিশ।
জালিয়াতরা ঠিক কীভাবে কাজটি করেছে, সে বিষয়ে এখনও স্পষ্ট কোনো ধারণা পায়নি ডাচ-বাংলা কর্তৃপক্ষ। তবে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সনাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সাইবার সিকিউরিটি বিভাগের অতিরিক্ত উপ কমিশনার মো. নাজমুল ইসলাম বলছেন, এ ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে। ব্যাংকের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে এবারই প্রথম।
“এক ধরনের কার্ড তারা ব্যবহার করেছে, যা বুথের এটিএম মেশিনের কম্পিউটারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং মূল সার্ভারে বার্তা পাঠানো বন্ধ করে দেয়। তারপর বুথের টাকা কমান্ড অনুযায়ী বের করে দেয়। তবে কোনো ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা কাটে না।”
ডাচ বাংলার এমডি বলেন, “তারা যদি এভাবে চালিয়ে যেতে পারত, তাহলে অনেক ক্ষতি হয়ে যেত।
তারা আমাদের ব্যাংক থেকে টাকা সরাতে পারত, অন্য ব্যাংক থেকেও টাকা সরাতে পারত ।”
যে ছয় বিদেশি নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের ৬ জুন ভারতে যাওয়ার কথা ছিল- এমন তথ্য দিয়ে আবুল কাশেম মো. শিরিন বলেন,
“ভারতে গিয়েও হয়ত তারা একই কাজ করত। আমরা তাদের একটা বড় পরিকল্পনা নষ্ট করে দিতে পেরেছি ।”
তিনি দাবি করেন, ডাচ বাংলার নেটওয়ার্ক ‘অনেক শক্তিশালী’ বলেই জালিয়াদের দ্রুত ধরা সম্ভব হয়েছে। দেশের অন্য অনেক ব্যাংকের ক্ষেত্রে এটা সম্ভব নাও হতে পারত।
“বাড্ডার একটা এটিএম বুথ থেকে তারা আমাদের তিন লাখ টাকা নিতে পেরেছে। এরপরে অন্য একটি বুথে গিয়েছিল, সেখান থেকে টাকা সরাতে পারেনি। কোনো কাস্টমারের কোনো ক্ষতি হয়নি।”
জালিয়াতরা কীভাবে সিস্টেম হ্যাক করল তা বুঝতে ডিবি পুলিশের পাশাপাশি ডাচ বাংলা কর্তৃপক্ষও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কাজ করছে বলে জানান আবুল কাশেম।
তিনি বলেন, “আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে এক্সপার্ট নিয়ে আসছি এবং ভেন্ডরদের নিয়ে আসছি। আমরা বের করার চেষ্টা করছি যে এটিএম থেকে এ ধরনের চুরি কীভাবে করা হল। যদি আমরা বের করতে পারি যে চুরিটা কীভাবে করা হল, তাহলে আমরা ভালোভাবে প্রোটেকশন দিতে পারব।”
ডাচ বাংলার এটিএম বুথগুলোর নিরাপত্তা ইতোমধ্যে বাড়ানো হয়েছে জানিয়ে এমডি বলেন, “এই মুহূর্তে আমরা ফিজিক্যাল প্রোটেকশন বাড়িয়েছি। তবে টেকনিক্যাল প্রোটেকশন নিতে পারিনি, কারণ এখনো আমরা ভালোভাবে জানি না চুরিটা কীভাবে করা হল। আমরা আমাদের বুথগুলোতে নিরাপত্তা বাড়িয়েছি, পাশাপাশি চারদিকে সর্তকতা অবলম্বন করছি।”
১৯৯৫ সালে যাত্রা শুরু করা ডাচ-বাংলা ব্যাংকের গ্রাহক সংখ্যা এখন ২ কোটি ৫০ লাখ বলে এর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। সারাদেশে এ ব্যাংকের শাখা রয়েছে ১৮৪টি। এছাড়া ৫ হাজারের মতো এটিএম বুথ এবং ৮০০টি ফাস্ট ট্র্যাক সার্ভিস রয়েছে ব্যাংকটিতে। এই সংখ্যা অন্য যে কোনো ব্যাংকের চেয়ে বেশি।
অতিরিক্ত উপ কমিশনার নাজমুল বলেন, “এভাবে টাকা তোলার ঘটনা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, এমনকি ভারতেও হয়েছে। এখন যেহেতু বাংলাদেশেও অভিযোগ পাওয়া গেছে, আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছি। ব্যাংকগুলোর সিকিউরিটি ব্যবস্থা আরও শক্তিশালি করার সময় এসেছে।”
এর আগে ২০১৬ সালে ইস্টার্ন ব্যাংক, সিটি ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) চারটি এটিএম বুথ থেকে গ্রাহকের তথ্য চুরি করে ক্লোন কার্ড তৈরির মাধ্যমে গ্রাহকের ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। ওই ঘটনাতেও জড়িত ছিল বিদেশিরা।
এছাড়া ২০১৮ সালে একটি সুপারশপ থেকে গ্রাহকদের তথ্য চুরি করে ক্লোন কার্ড তৈরির মাধ্যমে ৪৯ জনের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে।