বেসরকারি খাতের এনআরবি ব্যাংকের তিন পরিচালকের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ লক্ষ্যে দুদক দুটি আলাদা টিমও গঠন করেছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক তথ্য অনুসন্ধানের কাজও শুরু হয়েছে।
প্রয়োজনীয় অন্যান্য তথ্য ও দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটসহ (বিএফআইইউ) বিভিন্ন সংস্থার কাছে চিঠি দিয়েছে দুদক। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
দুদক সূত্র জানায়, এনআরবি ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার আমিনুর রশিদ খান, তার দুই ছেলে ও ব্যাংকের পরিচালক নাফিহ রশিদ খান এবং নাভিদ রশিদ খানের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ নিয়ে অনুসন্ধান চলছে।
এ ছাড়াও তাদের তিনজনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচারের অভিযোগেও অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এসব অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য সম্প্রতি দুই সদস্যের টিম গঠন করে দুদক।
সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল হককে প্রধান করে গঠিত এ টিমে সদস্য হিসাবে রাখা হয়েছে উপসহকারী পরিচালক সহিদুর রহমান ও মিরাজ হোসেনকে।
এদিকে ওই টিম গঠনের পরই তারা সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে বিএফআইইউ-এর মহাব্যবস্থাপকের কাছে তথ্য চেয়ে ১৩ জানুয়ারি একটি চিঠি দিয়েছে।
এতে বলা হয়, ‘এনআরবি ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার আমিনুর রশিদ খান ও তার দুই ছেলে এনআরবি ব্যাংকের পরিচালক নাফিহ রশিদ খান ও নাভিদ রশিদ খানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতিসহ অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বিভিন্ন ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ শেয়ার ক্রয়সহ মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচারসহ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
এ অভিযোগ অনুসন্ধানের স্বার্থে উল্লিখিত ব্যক্তি বা তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে দেশে কিংবা বিদেশের কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কোনো চলতি, সঞ্চয়ী, এফডিআর, শেয়ার, লকারসহ অন্যান্য ব্যাংক হিসাব থাকলে সেসবের হিসাববিবরণী এবং কোনো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি থাকলে তার বিশদ বিবরণসহ এ সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
এ কারণে তাদের নামে হিসাব পাওয়া গেলে হিসাব খোলার ফরম, কেওয়াইসি প্রোফাইল, টিপি, এনআইডি, পাসপোর্ট, ট্রেড লাইসেন্স, আরজেএসসির নিবন্ধন, টিআইএন সার্টিফিকেট, হিসাববিবরণীসহ সংযুক্ত সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি রেকর্ডপত্রের ফটোকপি ৩০ জানুয়ারির মধ্যে দুদক কার্যালয়ে পাঠাতে হবে।
চিঠিতে আলাদা একটি ফরমে তাদের নাম, পিতা ও মাতার নাম এবং পাসপোর্ট নম্বরসহ বিভিন্ন তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়াও চিঠিতে যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-দেশ ট্রেডিং করপোরেশন, বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, জাব্বার জুট মিলস লিমিটেড, বাংলাদেশ মেডিকেল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি লিমিটেড, হাইড্রোকার্বন এবং এম ইশরাত হিমাগার লিমিটেড। এর বাইরে বিদেশি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নামও দেওয়া হয়েছে।
এগুলো হচ্ছে জেনট্রেড এফজেডই (সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কমোডিটি ট্রেডিং), কমোডিটি ফাস্ট ডিএমসিসি (ইন্টারন্যাশনাল কমোডিটি ট্রেডিং) সংযুক্ত আরব আমিরাত ও লোচ শিপিং ইন্টারমিডিয়েটরি এফজেডই (ইন্টারন্যাশনাল কমোডিটি ট্রেডিং) সংযুক্ত আরব আমিরাত। নাভিদ রশিদ খান এনআরবি ব্যাংকের পরিচালক ও অডিট কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান।
ব্যাংকের ওয়েবসাইটে তার পরিচিতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, তারা পারিবারিকভাবে এশিয়ার বৃহত্তর ভোক্তাপণ্যের ট্রেডিং ব্যবসা করেন। তিনি নিজে প্রতিষ্ঠা করেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে কমোডিটি ফাস্ট ডিএনসিসি নামের একটি কোম্পানি।
নাফিহ রশিদ খান এনআরবি ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির সদস্য। তিনি বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের সঙ্গে যুক্ত। তিনি দুবাইভিত্তিক বাংলাদেশি প্রবাসী। কমোডিটি ফাস্ট ডিএমসিসির পরিচালক। এটি বিশ্বব্যাপী কৃষিপণ্যের বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত।
সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে পুঁজি নিয়ে বিদেশে কোম্পানি করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের এ ধরনের কোনো অনুমোদন দেয়নি। তারা যদি বিদেশে অর্থ আয় করে থাকেন, তাহলে সেগুলোর মধ্যে খরচ মিটিয়ে বাকি অর্থ দেশে আনার কথা।
তবে সেগুলোও তারা আনেননি। এ কারণে দেশে কিংবা বিদেশে অর্জিত অর্থ হোক, তা গোপন করে দেশে না এনে পাচার করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে দুদক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনআরবি ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার আমিনুর রশিদ খান বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) বেনামি চিঠি দিয়ে কেউ অভিযোগ করে থাকতে পারেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। দুদকও কিছু জানায়নি।’
ব্যাংকের পরিচালক নাফিহ রশিদ খান এবং নাভিদ রশিদ খানের সঙ্গে তাদের মুঠোফোনে কথা বলার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
এদিকে একই ব্যাংকের পরিচালক ও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান এম বদিউজ্জামান এবং তার পরিবারের সদস্যের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ ও বিদেশে অর্থ পাচারের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।
এ লক্ষ্যে তিন সদস্যের আরও একটি টিম গঠন করা হয়েছে। দুদকের উপপরিচালক শামসুল আলমকে প্রধান করে গঠিত এ টিমে সদস্য হিসাবে রয়েছেন সহকারী পরিচালক শহিদুর রহমান ও সহকারী মিরাজ হোসেন।
সূত্র জানায়, এম বদিউজ্জামানের দেশে ছাড়াও বিদেশেও ব্যবসা রয়েছে। তিনি সিঙ্গাপুরে দুটি কোম্পানি গড়ে তুলেছেন। এগুলো হচ্ছে-সিঙ্গাপুরভিত্তিক তানিয়া ইন্টারন্যাশনাল পেট লিমিটেড, তানিয়া ডেভেলপমেন্ট পেট লিমিটেড।
দুদক থেকে তাদেরকে সম্পদবিবরণী দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হলে তারা প্রায় ৭০০ কোটি টাকার সম্পদের হিসাব জমা দিয়েছেন। এছাড়া তার দুই ছেলে এহসানুজ্জামান ও নাজিব জামান এবং মেয়ে তানিয়া জামানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক।
এনআরবি ব্যাংকের পরিচাFলক এম বদিউজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তার মুঠোফোনের দুটি নম্বরই বন্ধ পাওয়া গেছে।