বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ভবনটি নির্মাণের ক্ষেত্রে নানা অনিয়মের চিত্র বেরিয়ে এসেছে।
এই ভবনের ১৬ তলা থেকে ১৮ তলা পর্যন্ত অংশটিও সঠিক প্রক্রিয়ায় অনুমোদন নেওয়া হয়নি। ভবনটির ১৯ তলা থেকে ২৩ তলা পর্যন্ত সম্পূর্ণ অবৈধ। শিগগিরই এই ৫টি তলা ভেঙে ফেলা হবে। এসব অনিয়মের সঙ্গে রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যানসহ অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত ছিলেন।
বুধবার গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে পূর্তমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ. ম. রেজাউল করিম তদন্ত প্রতিবেদন সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন।
এ সময় তিনি বলেন, এফ আর টাওয়ারের নকশা-সংক্রান্ত অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যারা বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন, তাদের ব্যাপারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হবে। যারা অবসরে গেছেন, তাদের ব্যাপারেও বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি যারা এখনও রাজউকে কর্মরত আছেন, তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হবে। কয়েকটি তলার বিপরীতে মালিকপক্ষ ঋণ নিয়েছে। যারা এসবের সুযোগ দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেও প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ভবনের জমির মূল মালিক ছিলেন প্রকৌশলী এস এম এইচ আই ফারুক। অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ভবনটি নির্মাণ করে রূপায়ণ হাউজিং এস্টেট লিমিটেড। সে কারণে সংক্ষেপে ভবনের নাম হয় এফ আর টাওয়ার।
গত ২৮ মার্চ এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে ২৬ জন নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হন। অগ্নিকাণ্ডের পর গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ইয়াকুব আলী পাটোয়ারীকে প্রধান করে আট সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সাত কর্মদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল। পরে কয়েক দফা সময় বৃদ্ধি করা হয়।
শ. ম. রেজাউল করিম বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনটি সঠিকভাবে করার জন্য সময় বাড়ানো হয়েছিল। এবারের রিপোর্টে কারা জড়িত ছিল, তাদেরও চিহ্নিত করা হয়েছে। আর তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আলোর মুখ দেখে না- এই রিপোর্ট প্রকাশের মাধ্যমে সে ধারণাও ভুল প্রমাণিত হলো।
মন্ত্রী বলেন, ২৩ তলা এফ আর টাওয়ারটির ১৫ তলা পর্যন্ত সঠিক নিয়ম মেনেই হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রাজউকে আরও তিনটি তলা বৃদ্ধির আবেদন করে তারা। সেখানে আবেদনের প্রক্রিয়া সঠিক ছিল। কিন্তু অনুমোদনের প্রক্রিয়া সঠিক ছিল না। বিদ্যমান আইনের পরিবর্তে অতীতের আইনে ওই তিনটি তলার অনুমোদন দেওয়া হয়। এ ছাড়া ১৯ থেকে ২৩ তলা পর্যন্ত অংশের একটি নকশা মালিকপক্ষ রাজউকে উপস্থাপন করলেও সে-সংক্রান্ত কোনো তথ্য রাজউকে নেই।
তিনি বলেন, এমনকি ভবনের তলা বাড়াতে হলে যে ফি দিতে হয়, তার একটি রসিদ জমা দিয়েছিল তারা। রসিদটি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ওই টাকা রাজউকের অ্যাকাউন্টে জমা হয়নি। হয়তো দালাল চক্রের মাধ্যমে তারা রাজউকের বাইরে থেকে অতিরিক্ত তলাগুলোর অনুমোদন করিয়েছে। ফলে ১৮ তলার ওপরের তলাগুলো সম্পূর্ণ অবৈধ। এগুলো ভেঙে ফেলা হবে।
মন্ত্রী বলেন, ভবনের মালিকপক্ষ ২০, ২১ ও ২২ তলার বিপরীতে একটি ব্যাংক থেকে ঋণও নিয়েছে। যারা ঋণ দিয়েছে, সেটা সঠিক হয়নি।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ১৯৯৬ জারি হওয়ার পরও ১৯৮৪ সালের পুরনো বিধিমালায় ১৬ তলা থেকে ১৮ তলা পর্যন্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। এই দায় রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান হুমায়ুন খাদেম এড়াতে পারেন না। ১৫৫ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নির্ধারণ করা থাকলেও ১৯৩ ফুট উচ্চতার ভবনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এ দায় অথরাইজড অফিসার সৈয়দ মকবুল আহমেদ ও সহকারী অথরাইজড অফিসার বদরুজ্জামানের। তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন ও বিধি অনুযায়ী রাজউক ব্যবস্থা নেবে। এসবের সঙ্গে ভূমি মালিক ও ডেভেলপার রূপায়ণ এস্টেট অ্যান্ড হাউজিংয়ের মালিক জড়িত। এরই মধ্যে তাদের নামে মামলা হয়েছে। আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এতে আরও বলা হয়, এফ আর টাওয়ারের ১৬ থেকে ১৮ তলা পর্যন্ত নকশা অনুমোদনে বিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে। এই অনুমোদনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. হুমায়ুন খাদেম, রাজউকের সাবেক বোর্ড সদস্য ডিএম ব্যাপারি, সাবেক নগর পরিকল্পনাবিদ জাকির হোসেন, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইদুর রহমান, সাবেক অথরাইজড অফিসার-২ সৈয়দ মকবুল আহমেদ, সাবেক সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ উল্লাহ ও লিজ গ্রহীতা সৈয়দ মো. হোসাইন ইমাম ফারুক।
ভবনটির নির্মাণকালে যাদের দায়িত্ব পালনের কথা ছিল, তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি। তারাও দায়ী। তারা হলেন- প্রধান ইমারত পরিদর্শক মাহবুব হোসেন সরকার, ইমারত পরিদর্শক মো. আব্দুল গনি, আওরঙ্গজেব সিদ্দিকী নান্নু, আওলাদ হোসেন, আবু মুছা, নজরুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম, আব্দুস সাত্তার, বেল্লাল হোসেন, আলী আজম মিয়া, মোস্তফা জামান, মো. নুর আলম, জালাল উদ্দিন, সুরোত আলী রাসেল, মো. সিরাজ, শওকত আলী, ইমরুল কবির, ইলিয়াস মিয়া, নজরুল ইসলাম ও মো. খায়রুজ্জামান।
অবৈধভাবে নির্মিত অংশের বন্ধক অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজউকের যারা জড়িত ছিলেন তারা হলেন- রাজউকের তৎকালীন সদস্য (এস্টেট) রেজাউল করিম তরফদার, পরিচালক (সম্পত্তি ও ভূমি) শামসুল আলম, উপপরিচালক (এস্টেট ও ভূমি) মুহাম্মদ শওকত আলী, সহকারী পরিচালক শাহ মো. বদরুল আলম, সহকারী পরিচালক জাহানারা বেগম, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মজিবুর রহমান মোল্লা।
ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের অনিয়ম না ঘটে এ জন্য কমিটি বেশ কয়েকটি সুপারিশও দিয়েছে। এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে প্রত্যেকের স্পষ্ট নামসহ স্বাক্ষর করা, উচ্চতা লঙ্ঘনকারী অন্যান্য ভবন শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া, এস্টেট শাখার কার্যক্রম রাজউকের চেয়ারম্যানকে অবগত করা, বিল্ডিং কোড কমিটির মেয়াদ দুই বছর নির্ধারণ প্রভৃতি।