মমতাজ বেগম (২৬)। প্রত্যাবাসনের ছাড়পত্র পাওয়া এই নারী সাক্ষাৎকার দিয়ে বুথ কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ৩টার দিকে। বাড়ি মংডু গজবিল এলাকায়। এ সময় তার সঙ্গে কথা হয়।
তিনি বলেন, আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে মিয়ানমারে যাব কিনা? জবাবে ‘না’ বলেছি।
কেন যাবেন না জানতে চাইলে বলেন, ফেলে আসা সহায়-সম্বল, নাগরিকত্ব ও গণহত্যার বিচার পেলে যাওয়ার কথা বলেছি।
তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্বামী শামসুল আলমের কোলে থাকা ৩ মাসের ফুটফুটে সন্তান মোহাম্মদ রুমেনকে দেখিয়ে বলেন, কেমন করে মিয়ানমার ফিরে যাই বলুন, প্রত্যাবাসনের তালিকায় স্বামী ও সন্তানের নাম নেই। তাদের ছাড়া সেখানে কার সঙ্গে জীবন সংসার করব?
২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনী তার এলাকাতেই প্রথম হামলা চালিয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেখানে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি, সেখানে কি আবার মরতে যাব? এটি কখনোই হতে পারে। সেখানে এখনো আমাদের যাওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি।
এদিকে ২২ আগস্ট থেকে ১৩ দিন বন্ধের পর বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে প্রত্যাবাসনের ছাড়পত্র পাওয়া রোহিঙ্গাদের আবারও কক্সবাজারের টেকনাফ শালবাগান রোহিঙ্গা শিবিরে সাক্ষাৎকার শুরু হয়েছে। এতে তালিকাভুক্তদের মধ্যে মাত্র ৩৩ পরিবার জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) এবং বাংলাদেশের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) প্রতিনিধিদের কাছে তাদের মতামত জানিয়েছেন।
এ তথ্য নিশ্চিত করে আরআরআরসির প্রতিনিধি, জাদিমুরা ও শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইনচার্জ মোহাম্মদ খালেদ হোসেন বলেন, প্রত্যাবাসনের তালিকাভুক্ত এসব রোহিঙ্গারা তাদের মতামত জানিয়েছেন। তাদের মতামত একটি ফরমে লিপিবদ্ধ করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে। তবে প্রত্যাবাসনের তালিকায় নাম থাকা সব রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকারের জন্য আনা যায়নি, যোগ করেন সরকারি এই কর্মকর্তা।
এর আগে গত ২০, ২১ ও ২২ আগস্ট টেকনাফের শালবাগান শরণার্থী শিবিরে তৈরি করা বিশেষ বুথে ইউএনএইচসিআর এবং আরআরআরসির কর্মকর্তারা প্রত্যাবাসনে তালিকাভুক্ত ৩৩৯টি পরিবারের সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছিল। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী গত ২২ আগস্ট ৩ হাজার ৫৪০টি পরিবারের প্রত্যাবাসন হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত তারিখে রোহিঙ্গাদের অনিহার কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দ্বিতীয় বারের মত স্থগিত হয়ে যায়। প্রত্যাবাসনের তালিকাভুক্তদের মধ্যে শুধু শালবাগান রোহিঙ্গা শিবিরে ৯৩৩ পরিবারের ৩ হাজার ৪৫০ জনের নাম রয়েছে।
প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া শুরু হলে রোহিঙ্গারা আগের সুরে ফিরে আসে। এর আগের সাক্ষাৎকারেও রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা এবং গণহত্যাকারীদের বিচার চেয়েছেন। একই সঙ্গে নিজেদের ফেলে আসা সম্পত্তির অধিকার এবং ক্ষতিপূরণ চায় রাখাইন রাজ্য ত্যাগে বাধ্য হওয়া এই দরিদ্র জনগোষ্ঠী।
সাক্ষাৎকার দিতে আসা আরেক রোহিঙ্গা সোনা আলী (৩০) বলেন, ইউএনএইচসিআর আর ক্যাম্প ইনর্চাজের প্রতিনিধিরা ডেকে নিয়ে যাওয়ার পর সেখানে বলেছি, আমি এখন মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি নেই। কেননা সেদেশে মানুষ হত্যার বিচার করে না সরকার। জীবনের নিরাপত্তা এবং আমার ভিটে মাটি ফিরে না পেলে কেন যাব?” প্রশ্ন রাখেন তিনি।
প্রত্যাবাসনের সঙ্গে যুক্ত থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, শালবাগান রোহিঙ্গা শিবির ছাড়াও নতুন করে আগামী সপ্তাহে লেদা রোহিঙ্গার শিবিরে ২৪ ও ২৫ নম্বর ক্যাম্পের প্রত্যাবাসনের তালিকায় নাম থাকা রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে। তবে যেসব রোহিঙ্গারা সাক্ষাৎকার দিয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ শর্তবিহীন মিয়ানমারে ফিরতে রাজি হয়নি।