করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সপ্তাহখানেক বন্ধ থাকার পর রোববার খোলার কথা ছিল গার্মেন্টসহ বিভিন্ন রপ্তানিমুখী কারখানা। কাজে যোগ দিতে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অনেকেই শনিবার দিনভর ফিরেছেন ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে। করোনা ঠেকানোর ‘লকডাউন’-এর অংশ হিসেবে বাসসহ সব গণপরিবহন বন্ধ থাকায় কর্মস্থলে ফিরতে তারা পথে পথে দুর্ভোগে পড়েন। অনেক কর্মী ৪০-৫০ কিলোমিটার হেঁটে কর্মস্থলে এসেছেন। করোনা থেকে বাঁচতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনা থাকলেও লাখ লাখ মানুষ ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, পিকআপ, ফেরিতে গাদাগাদি করে ফিরেছেন।
এদিকে রোববার রাতে এক ভিডিওবার্তায় তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক পোশাক কারখানা আগামী ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ রাখার জন্য মালিকদের প্রতি অনুরোধ জানান।
করোনার বিস্তার রোধে গত ২৬ মার্চ থেকে ১০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। ২৯ মার্চ থেকে বন্ধ হয়ে যায় কলকারখানাও। পরে সাধারণ ছুটি ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। গণপরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞাও ৪ এপ্রিল থেকে ওই দিন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। সবাইকে ঘরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। তবে কলকারখানায় ছুটি বাড়েনি। আজ খুলেছ গার্মেন্ট।
বিকেএমইর সিনিয়র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানিয়েছেন, তাদের সংগঠনভুক্ত ৪০ শতাংশ কারখানা আজ খুলছে। নতুন রপ্তানি আদেশ নেই। যাদের হাতে পুরোনো রপ্তানি আদেশ ও করোনা থেকে স্বাস্থ্যকর্মীদের রক্ষায় পিপিই তৈরির কাজ আছে, তারাই কারখানা খুলছেন। যারাই কারখানা খুলবেন, তাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বলা হলেও আগের দিনের মতো রোববার শ্রমজীবী মানুষের উপচে পড়া ভিড় ছিল মহাসড়কগুলোতে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, লাখো মানুষের ঢল ঠেকানো সম্ভব নয়। কর্মস্থলে ফেরা মানুষের বক্তব্য, তারাও নিরুপায়। চাকরি বাঁচাতে হলে এ ছাড়া আর উপায় নেই। কারখানা খুললে মার্চের বেতন পাবেন। বেতন না পেলে সংসার চলবে না। তাই করোনার ঝুঁকি উপেক্ষা করে কাজে যোগ দিতে যাচ্ছেন।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানিয়েছে, আশপাশে জেলা ও উপজেলা থেকে রোববার কয়েক লাখ শ্রমজীবী মানুষ চট্টগ্রাম শহরে ফিরেছেন। চট্টগ্রামের জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ডা. সুশান্ত বড়ূয়া বলেছেন, যে সময়ে বন্ধ রাখা অত্যন্ত জরুরি, ঠিক সেই সময়ে মালিকরা মুনাফার লোভে কারখানা খুলে দিয়েছেন। এ সিদ্ধান্ত অপরিণামদর্শী। করোনা ছড়ালে এক-একেকটি কারখানা হবে করোনার খামার।
নগরের সিটি গেট, শাহ আমানত সেতু, অক্সিজেন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে করে দলে দলে নগরে ফিরছেন শ্রমিকরা। আশপাশের উপজেলা থেকে হেঁটেও এসেছেন অনেকে।
ময়মনসিংহ ব্যুরো জানিয়েছে, আগের দিনের মতো গতকাল ঢাকামুখী শ্রমজীবী মানুষের স্রোত ছিল। করোনা মোকাবিলায় প্রশাসন সবাইকে ঘরে থাকার নির্দেশনা দিলেও ব্রহ্মপুত্র সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা যায় ঢাকামুখী মানুষের ঢল। ঢাকা যেতে শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা জেলা এবং ময়মনসিংহের বিভিন্ন উপজেলার হাজারো মানুষ সেখানে ভিড় করেছেন। তারা হেঁটে, রিকশায় ও অটোরিকশায় করে ৪০-৫০ কিলোমিটার দূর থেকে ময়মনসিংহ এসেছেন। কিন্তু ময়মনসিংহ থেকে বাস, ট্রাক কিছুই পাচ্ছেন না। কেউ রিকশায় রওনা করছেন ১১৩ কিলোমিটার দূরের ঢাকায়। কেউ যাচ্ছেন অটোরিকশা ও ইজিবাইকে। তারা জানালেন, ভেঙে ভেঙে যাবেন। আবার অনেকে রওনা করেছেন হেঁটেই।
ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমান জানান, গার্মেন্ট কর্মীরা খুবই কষ্ট করে যাচ্ছেন। জেলা মোটর মালিক সমিতির সঙ্গে কথা বলে তাদের গন্তব্যে পাঠানোর চেষ্টা চলছে।
গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, ঢাকা অভিমুখে লাখো মানুষের ঢল। শুক্রবার ভোররাত থেকে তারা হেঁটে গাজীপুর এসেছেন। যেখানে ট্রাক, পিকআপ পেয়েছেন, সেখানে চড়েছেন। মাওনা হাইওয়ে থানার ওসি মনজুরুল হক বলেন, কারখানা বন্ধ ঘোষণার পর শ্রমিকরা গ্রামের বাড়ি চলে যান। কারখানা খোলায় বেতনের আশায় তারা ফিরে আসছেন। পণ্যবাহী গাড়িতে যাত্রী পরিবহনের দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে শ্রীপুর উপজেলা পরিষদ। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফারজানা নাসরিন জানান, ১৯টি গাড়িকে ১৯ হাজার ৭০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
বড়াইগ্রাম (নাটোর) প্রতিনিধি জানান, কাকডাকা ভোর থেকে বনপাড়া বাইপাসে মুখে মাস্ক আর কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হাজারো মানুষের ঢল নামে। একটি কভার্ডভ্যানের পেছনে বন্ধ বাক্সে গাদাগাদি করেও মানুষ ঢাকার উদ্দেশে রওনা করেন। ঝুঁকি নিয়ে খোলা রাখা হয় বক্সের দরজা। চালক জানান, দরজা বন্ধ করা হলে পেছনে থাকা সব মানুষ মারা যাবেন দম বন্ধ হয়ে।
শেরপুর (বগুড়া) প্রতিনিধি জানান, ঢাকা যাওয়ার উদ্দেশে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে বগুড়ায় আসছেন শ্রমজীবী মানুষ। সেখান থেকে রিকশা, ভ্যানে করেও রওনা হন তারা। ভেঙে ভেঙে যাবেন ঢাকায়।
বাবুগঞ্জ (বরিশাল) প্রতিনিধি জানান, বরিশালসহ দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলো থেকেও ঢাকামুখী মানুষের ঢল ছিল। লঞ্চ বন্ধ থাকায় শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নছিমন, করিমনেও করেও মানুষ রাজধানীর পথ ধরে।
গৌরনদী (বরিশাল) প্রতিনিধি জানান, যাত্রী পরিবহন করায় তিনটি ট্রাক আটক করে চালক ও হেলপারকে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) প্রতিনিধি জানান, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুট দিয়ে রোববার হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষ নদী পার হন। ফেরিতে যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ হলেও তারা পণ্যবাহী গাড়ির সঙ্গে ফেরিতে চড়েন।
বিআইডব্লিউটিসির দৌলতদিয়া ঘাট ব্যবস্থাপক আবু আব্দুল্লাহ রনি জানান, ১৬টি ফেরির ১১টি বন্ধ রয়েছে। গতকাল দুপুর থেকে মানুষের চাপে পণ্যবাহী যানবাহন পারাপার করা যাচ্ছে না। করোনা ঝুঁকি থাকলেও ফেরিতে তাদের পারাপার ঠেকানো যাচ্ছে না।