প্রশ্নের মুখে পড়েছে ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের নানা প্রস্তাব। প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রায় দ্বিগুণ ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে প্রকল্পটির। এক্ষেত্রে শুধু এসএমএস সেবার নামেই চাওয়া হয়েছে ৯ কোটি ২০ লাখ টাকা।
সেই সঙ্গে অনুমতি ছাড়াই ২১ আইটেমের মধ্যে ১১টিতেই অতিরিক্ত দামে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। এতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা কমিশন। পাশাপাশি বিধিনিষেধ থাকলেও বিদেশ ভ্রমণ খাতে খরচ বাড়িয়ে ৪৫ কোটি টাকা করার আবদার করা হয়েছে।
আরও আছে বাড়তি দামে ক্যামেরা কেনাসহ বিভিন্ন অস্পষ্ট ব্যয় প্রস্তাব। ‘বাংলাদেশ ই-পাসপোর্ট ও স্বয়ংক্রিয় বর্ডার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন’ শীর্ষক প্রকল্পের প্রথম সংশোধনী প্রস্তাব ঘিরে এসব তথ্য উঠে আসে। ৩ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা।
ওই সভায় বিভিন্ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে আপত্তি জানানো হয়েছে কমিশনের পক্ষ থেকে-খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এ প্রসঙ্গে ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে. মুজেরী শনিবার বলেন, প্রকল্প প্রস্তাবটি পরিকল্পন কমিশনে আসার আগে বিভিন্ন ধাপ পার হয়ে আসার কথা। এরপরও যদি এমন প্রস্তাব থাকে তাহলে বুঝতে হবে প্রকল্প প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় গলদ আছে।
কেননা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থা যদি মনে করে, আমরা যেনতেন ভাবে একটা ব্যয় ধরলাম, পরিকল্পনা কমিশন কিছু টাকা কমিয়ে দেবে। তারপরও তো লাভ থাকবে। এ রকম হলে এখানে উদ্দেশ্যের মধ্যে সমস্যা থাকে। এ প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাব দেখে বোঝা যায় প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণের ডিসিপ্লিন ভেঙে পড়েছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিধি না মেনে অতিরিক্ত চুক্তি করা মানেই হলো ঔদ্ধত্যপূর্ণতা প্রদর্শন করা। নিয়মকে অবজ্ঞা করা। কাজেই এটা অবশ্যই অনিয়ম। এরকম বিষয় কঠোর হস্তে দমন করা উচিত।
সূত্র জানায়, ‘বাংলাদেশ ই-পাসপোর্ট ও স্বয়ংক্রিয় বর্ডার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন’ শীর্ষক প্রকল্পটির মূল ব্যয় ছিল ৪ হাজার ৬৩৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২৮ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের কথা। কিন্তু বর্তমানে ৯ হাজার ২৭১ কোটি টাকা ধরে প্রথম সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। এতে বাড়ানো হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। অর্থাৎ ৪ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা।
ব্যয় বাড়ানোর যুক্তি হিসাবে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে উদ্বোধনের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ লাখ বাংলাদেশিকে ই-পাসপোর্ট দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে সিডি ভ্যাট এবং ট্যাক্স বৃদ্ধি, বিশেষায়িত কারিগরি সংরক্ষণাগার ভাড়া, ব্যাকেন্ড ভ্যারিফিকেশন সহজীকরণ, নতুন হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার কেনার কারণে ব্যয় বাড়ানোর প্রয়োজন।
আরও আছে অতিরিক্ত পাসপোর্ট তৈরির কাঁচামাল ও বুকলেট আমদানি, বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে অতিরিক্ত চুক্তিমূল্যসহ নানা কারণে প্রকল্পটি সংশোধন করতে হচ্ছে।
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, মোবাইল ফোনে এসএমএস সেবার নামে সংশোধনী প্রস্তাবে নতুন করে চাওয়া হয়েছে ৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। কিন্তু পিইসি সভায় বলা হয়, পাসপার্টের জন্য আবেদন গ্রহণ এবং আবেদনকারীদের জানানোর কাজটি পাসপোর্ট অধিদপ্তরের নিজস্ব কাজ।
প্রকল্পের মাধ্যমে এবং প্রকল্পের অর্থে এসএমএস দেওয়া এবং এ খাতে ব্যয় করার সুযোগ আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মাধ্যমে এ কাজটি রাজস্ব বাজেট হতে অর্থ ব্যয় করতে হবে। কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মূলধন খাতে ২১টি আইটেমের মধ্যে ১১টি আইটেম কোডে অনুমোদিত ডিপিপির (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) চেয়ে বাড়তি টাকায় চুক্তি করা হয়।
এক্ষেত্রে মোট ২৪৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা বেশি মূল্যে জার্মান কোম্পানি ভেরিডোস জিএমবিএইচ’র সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী অনুমোদিত বরাদ্দের বেশি দামে চুক্তি করতে পরিকল্পনা কমিশনের অনুমতি নিতে হয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সম্মতি না নেওয়ায় চুক্তিটি বিধিসম্মত হয়নি।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাদাত হোসেন ওই সভায় ব্যাখ্যা দেন।
এ সময় তিনি বলেন, ডিপিপি অনুমোদিত হয় ২০১৮ সালে, পরে ২০২০ সালে চুক্তি করার সময় সব আইটেমের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া ১১টি আইটেমের হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যারের নতুন কিছু আপগ্রেডেশন ও কারিগরি বৈশিষ্ট্য যুক্ত হওয়ায় এসবের দাম বেড়েছে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, অনুমোদিত ২১ আইটেমের মধ্যে ১০টি আইটেমে অনুমোদিত ব্যয়ের চেয়ে ১০০ কোটি টাকা কম মূল্যে চুক্তি করা হয়েছে। এসময় সভার সভাপতি ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান অধিক মূল্যে চুক্তি করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
সভায় অংশ নেওয়া অন্যান্যরা বরাদ্দ দেওয়া অর্থের বেশি যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমানি না নিয়ে চুক্তি করায় বিধির ব্যত্যয় বলে উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা এবং সুরক্ষা ও সেবা বিভাগকে একটি প্রতিবেদন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, বর্তমান বৈশ্বিক সংকটের কারণে বৈদেশিক ভ্রমণে বাধা-নিষেধ থাকলেও এ খাতে বাড়তি বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। মূল ডিপিপিতে এ খাতে অনুমোদিত ব্যয় ধরা ছিল ২০ কোটি টাকা। জুন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৮ কোটি ৮৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা। বিমান ভাড়া বৃদ্ধি পাওয়ার অজুহাতে বিদেশ ভ্রমণে বাড়তি ২৫ কোটি টাকাসহ মোট ৪৫ কোটি টাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এতে আপত্তি দিয়েছে পিইসি।
বলা হয়েছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ পরিপত্র অনুযায়ী জিওবি (সরকারি তহবিল) খাতের টাকায় বিদেশ ভ্রমণ নিরুসাহিত করা হয়েছে। এছাড়া এ খাতের টাকায় কোথায় এবং কোন পর্যায়ের কর্মকর্তা/কর্মচারী বিদেশ ভ্রমণ করবে সেটি প্রস্তাবে বলা হয়নি।
বিস্তারিত আলোচনার পর শুধু কারিগরি প্রয়োজনে মাত্র ২-৩ জনের একটি টিম গঠন করতে বলা হয়েছে। এছাড়া বিদেশ ভ্রমণের বিস্তারিতসহ এ খাতে ব্যয় কমাতে বলা হয়েছে।
পিইসি সভা সূত্র জানায়, অনুমোদিত প্রকল্পের আওতায় মূলধন খাতে ১ হাজার ২৬৯টি ওয়েবক্যাম (ক্যামেরা) কেনার জন্য ১ কোটি ৭৬ লাখ ৭৪ হাজার টাকার সংস্থান ছিল। কিন্তু ওই টাকা দিয়ে শুধু ৪০০টি ওয়েবক্যাম কেনা হয়েছে। সংশোধিত ডিপিপিতে এ খাতে ১৫ কোটি ২৮ লাখ ২৬ হাজার টাকা বাড়ানো হয়েছে। মোট বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ১৭ কোটি ৫ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে সভায় প্রশ্ন তোলা হলে প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাদাত হোসেন সভায় বলেন, ডিপিপিতে উল্লেখ করা ক্যামেরার ছবির মান ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে সন্তোষজনক না হওয়ায় উন্নত ক্যামেরা কেনা হয়েছে।
এক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মানা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের অনুমতি ছাড়া ক্যামেরার একক মূল্য ১৪ হাজার টাকার চেয়ে বেশি দামে অর্থাৎ ৪৪ হাজার টাকায় কেনার বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলেছে পিইসি।
সভায় অংশ নিয়ে আইএমইডির প্রতিনিধি বলেন, নতুন করে প্রস্তাবিত হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার খাতে বৈদেশিক মুদ্রায় ৭৪ কোটি ১১ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে সংস্থাপন ব্যয় ২৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা এবং যন্ত্রপাতি ও সফটওয়্যার ব্যয় ৪৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে সংস্থাপন খরচ মূল আইটেমের প্রায় ৫০ শতাংশ। যেটি অত্যাধিক বলে প্রতীয়মান হয়।