এ দেশে কেবল বামপন্থারই আছে অনন্তকালের আয়ু

9-12-5bb23d825cc0f

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষা ও বিকাশ কেবল বামপন্থা এবং বামপন্থিদের মাধ্যমেই সম্ভব। এমন প্রেক্ষাপটে এ দেশের রাজনীতিতে বামপন্থা ও বামপন্থিদের শুধু ভবিষ্যৎই নয়, কেবল বামপন্থারই আছে ‘অনন্তকালের আয়ু’। সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে ও মানুষকে ভালোবেসে ইতিহাসের সেই চাহিদা মেটানোর জন্য সবার চেষ্টা চালানোই হবে মনুষ্যত্বের শ্রেষ্ঠ পরিচয়। দেশের সবচেয়ে পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী বামপন্থি দল সিপিবির বাহাত্তরতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সামনে রেখে গতকাল বৃহস্পতিবার  দেওয়া সাক্ষাৎকারে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এসব কথা বলেন। আজ শুক্রবার দেশজুড়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করবে দলটি।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বামপন্থার ভবিষ্যৎ প্র্রসঙ্গে বলতে গিয়ে প্রবীণ এই বামপন্থি রাজনীতিবিদ বলেন, এ দেশের ভবিষ্যৎ যদি কিছু থাকে, সেটা একমাত্র বামপন্থাতেই আছে। দক্ষিণপন্থি বাজার অর্থনীতির পূজারিদের ক্রমাগত দুঃশাসন এদেশে লুটপাটতন্ত্রের জন্ম দিয়েছে। সেই দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে কার্যকর উত্তরণ কেবল বামপন্থা ও বামপন্থিদের মাধ্যমেই সম্ভব।
কমিউনিস্ট পার্টির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, কমিউনিস্ট পার্টির একটি বৃহত্তর, বৈশ্বিক এবং সর্বময় লক্ষ্য রয়েছে, যা তারা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেই আন্দোলন পরিচালনা করছে। এই লক্ষ্যটি হচ্ছে, মানবসভ্যতাকে বর্তমান অধ্যায় থেকে সমাজতন্ত্র এবং সাম্যবাদী সভ্যতায় উত্তীর্ণ করা। এই উত্তরণের ক্ষেত্রে মেহনতি মানুষ বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণিকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করতে হবে। তাই শ্রমিক শ্রেণিকে ভিত্তি করে সাম্যবাদের লক্ষ্যে আন্দোলন-প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই কমিউনিস্ট পার্টির দূরবর্তী এবং প্রধান লক্ষ্য। এই লক্ষ্য পূরণে ক্রমাগত লড়াই-সংগ্রাম পরিচালনা করেই কমিউনিস্টরা নিজেদের কর্মপন্থাকে এগিয়ে নেবেন।

সেলিম বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে কমিউনিস্ট পার্টির একটা মৌলিক লক্ষ্যও রয়েছে। সেটি হচ্ছে ‘ভিশন মুক্তিযুদ্ধ’। দেশকে আবারও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়েই কমিউনিস্ট পার্টি লড়াইয়ের ময়দানে রয়েছে।

প্রতিষ্ঠার ৭২ বছরে কমিউনিস্ট পার্টির লক্ষ্য কতটুকু পূরণ হয়েছে- এমন প্রশ্নে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, চূড়ান্ত লক্ষ্য পূরণ হতে অনেক সময় লাগবে। তবে গত ৭২ বছরে কমিউনিস্ট পার্টি সেই পথে অনেকটাই অগ্রসর হয়েছে। যেমন প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কমিউনিস্ট পার্টি বলে আসছে, ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’। এভাবে সংগ্রামের সূচনা কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টিই করেছিল। পাকিস্তানের দ্বিজাতিতত্ত্বকে একটা কৃত্রিম ও ভ্রান্ত মতবাদ বলে আখ্যায়িত করে তার বিরুদ্ধে এ পার্টিই প্রথম সংগ্রাম শুরু করেছিল। গণতন্ত্রের জন্য মুসলিম লীগের শাসন, পরবর্তীকালে আইয়ুবি শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির স্বাধিকারের জন্য প্রথম দিন থেকেই কমিউনিস্টরা নিরবচ্ছিন্নভাবে এবং কোনো দ্বিধা না করে দৃঢ়তার সঙ্গে কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন। এসব সংগ্রামে অন্যরাও শামিল হয়েছে, কিন্তু কমিউনিস্টদের অবদান ছিল অগ্রগণ্য। কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন এবং তাদের বেঁচে থাকার জন্য ভাত-কাপড় ও রুটি-রুজির আন্দোলনকে বিকশিত করার ভেতর দিয়ে আমরা সেটিকে জাতীয় আন্দোলনের পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। এসবের পরিণতিতেই কিন্তু আমরা একাত্তর সালে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভেতর পৌঁছতে পেরেছি, যা একটা সমাজতন্ত্র অভিমুখীন লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে।

কমিউনিস্ট পার্টির চলার পথের প্রতিবন্ধকতাকে তুলে ধরে সেলিম বলেন, সমগ্র কালপর্বে পাকিস্তানি শাসকরা সবচেয়ে নিষ্ঠুরভাবে দমননীতি চালিয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির ওপরই। প্রথম জেল হত্যাকাণ্ড কিন্তু উনিশশ’ পঁচাত্তর সালে হয়নি- হয়েছে ১৯৫০ সালে। হয়েছে রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে কমিউনিস্টদের গুলি করে হত্যার মধ্য দিয়ে। জেলখানাগুলো ছিল আগাগোড়াই কমিউনিস্টদের চিরস্থায়ী বাসস্থান। বঙ্গবন্ধু তার ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়েও লিখেছেন, ‘কমিউনিস্টরা তো সেখানে আছেই। তাদের সঙ্গে আমাকে মিশতে দেওয়া হতো না। পাছে বিপথে চলে যাই।’ কমিউনিস্টরাই কিন্তু সামরিক আইনের বেত্রদণ্ডে আহত হয়ে শ্রবণশক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছেন। অনেকটা সময় ধরে এই ভূখণ্ডে কমিউনিস্ট রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। তারপরও শত প্রতিকূলতা ও বাধা-বিপত্তি মোকাবিলা করেই কমিউনিস্টরা দুর্বার গতিতে এগিয়ে গেছেন সম্মুখপানে।

তবে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথে নিজেদের ভুলত্রুটি ও সীমাবদ্ধতাকেও অকপটে স্বীকার করেছেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তার ভাষায়, বামপন্থিদের জন্য যেটা করা সম্ভব, সেটা কেবল ঘোষণা করলেই হবে না। সেই শক্তিটাও থাকতে হবে। তা ছাড়া অতীত যদি দেখি, দেখা যাবে আমাদেরও অনেক ঘাটতি আছে, ভুল-ত্রুটি আছে। তবে সেগুলোকে একেবারে খোলামেলাভাবে স্বীকার করে নিয়েই আমরা সংশোধন করে এগোনোর চেষ্টা করি। বামপন্থিরা জনগণকে পরিত্যাগ করে চলে যাননি। জনগণের সংগ্রামের অর্জনকে ধুলায় লুটিয়েও দেননি। বরং জনগণের সঙ্গে থেকে তাদের অধিকার আদায়ের লড়াই-সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট ছিলেন।

‘এদেশের রাজনীতি ও মানুষের মধ্যে অবস্থান করে নেওয়ার ক্ষেত্রে, আন্দোলন-সংগ্রাম এবং নির্বাচনসহ অনেক ক্ষেত্রে বামপন্থিদের ব্যর্থতার ইতিহাসও রয়েছে’- এমন ধারণার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘ইতিহাস কিন্তু এখনও শেষ হয়নি। সংগ্রাম চলছেই। আমি তো বামপন্থিদের কোনো ব্যর্থতাও দেখি না। তবে আমরা এখনও পর্যন্ত সাফল্য পরিপূর্ণভাবে অর্জন করতে পারিনি। সেটাও অর্জন করে ফেলব- আজ না পারি, কাল করব। মনে রাখতে হবে, ব্রিটিশরা এদেশে দু’শ বছর রাজত্ব করেছে, জমিদারি ব্যবস্থাও শত শত বছর বহাল থেকেছে। পাকিস্তানিরাও ২৪ বছর এদেশে টিকে ছিল। কিন্তু এই দিনই দিন নয়, আরও দিন আছে। এই দিনকে নিতে হবে সেই দিনের কাছে।’

Pin It