‘এমন আজব মানুষ আমি দেখি নাই। জানমালের ক্ষতি করেও থামানো যাচ্ছে না তাদের। এই মানুষগুলা কোন ধাতুর তৈরি!’ সিলেটের পাথররাজ্য খ্যাত কোম্পানীগঞ্জের আলোচিত শাহ আরেফিন টিলায় বারবার অভিযান চালিয়েও পাথরখেকোদের হাত থেকে টিলাটি রক্ষা করা প্রসঙ্গে এমন প্রতিক্রিয়া জানান উপজেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করলে অভিযান হবে জেনেও পাথরখেকোরা ভয় পায় না। এরা কোন ধরনের মানুষ! সুযোগ বুঝেই বিভিন্ন ধরনের পাথর উত্তোলন যন্ত্র নিয়ে কোয়ারিতে নেমে পড়ে। অথচ নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনছে।’ তিনি মনে করেন, নেপথ্যের হোতাদের আইনের আওতায় না আনা পর্যন্ত ধ্বংসযজ্ঞ থামবে না। শুধু ওই প্রশাসনিক কর্মকর্তার এমন অভিমত নয়; স্থানীয় বাসিন্দা, পুলিশ, বিজিবি ও উপজেলা প্রশাসনের লোকজনও মনে করেন, বেপরোয়া লোকদের থামাতে হলে তাদের মূলে হাত দিতে হবে।
গত দুই মাসে আরেফিন টিলায় কম হলেও ৭-৮টি অভিযান চালায় উপজেলা প্রশাসন। এমনকি পুলিশও পৃথক অভিযান চালিয়েছে। এসব অভিযানে কাউকে আটক করা না হলেও ধ্বংস করা হয় পাথর উত্তোলন যন্ত্রসহ বিভিন্ন অনুষঙ্গ। মামলাও হয় মাঝেমধ্যে। অভিযানের ফলে পাথর উত্তোলনকারীদের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ কোটি টাকার ওপর। তার পরও তারা থেমে থাকেনি। শুধু সম্পদের নয়, ইতোমধ্যে কয়েক বছরে পাথররাজ্যে অর্ধশত লোকের প্রাণহানিও ঘটেছে। নানা কৌশল নিয়ে অভিযান চালিয়েও থামানো যাচ্ছে না পাথরখেকোদের। সর্বশেষ সোমবার আরেফিন টিলায় অভিযান চালায় উপজেলার সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্স। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমন আচার্যের নেতৃত্বে ভোলাগঞ্জের ধলাই সেতু এলাকা ও শাহ আরেফিন টিলায় অভিযান চালিয়ে ৭৩টি শ্যালো মেশিন (পাথর উত্তোলনের নিষিদ্ধ যন্ত্র), ৩৫টি বারকি নৌকা, ৬ হাজার ২শ’ ফুট পাইপ ধ্বংস ও ১৮টি ট্রাক্টরের চাকা ফুটো করা হয়। এমনকি অভিযানকালে ৩৫টি কোয়ারির (পাথর উত্তোলনের গর্ত) বাঁধ কেটে পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। সোমবারের এক অভিযানেই ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমন আচার্য। তিনি বলেন, ‘এত অভিযানের পরও যখন পাথর উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না, তখন বিকল্প ভাবতে হবে আমাদের। আমরা কোনোভাবে কাউকে অন্যায় কাজ করতে দিতে পারি না।’
এর আগে ২৮ ডিসেম্বর শাহ আরেফিন টিলায় অভিযান চালিয়ে ৯টি পাথরের গর্ত ডুবানো হয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে ১৮টি শ্যালো মেশিন, ৪ হাজার ফুট পাইপ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি। এতে ক্ষতি হয় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকার। এ ছাড়া ১৩ নভেম্বর ২২টি মেশিন ও ৫ হাজার ফুট পাইপ উদ্ধার করে ধ্বংস, ৭ নভেম্বর ১৭টি যন্ত্র ধ্বংসসহ নভেম্বর ও ডিসেম্বরে আরও কয়েকটি অভিযানে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার ক্ষতি করা হয়। টিলাটির অবশিষ্ট অংশ ও এলাকার পরিবেশ রক্ষায় উপজেলা প্রশাসন ও থানা পুলিশ ইতোমধ্যে নানা পদক্ষেপও নেয়। গত ১ ডিসেম্বর পাথরখেকোদের হাত থেকে আরেফিন টিলা রক্ষায় টিলার ৩টি প্রবেশপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর আগে লাল পতাকা টানানো, মাইকিং করে টিলা থেকে পাথর উত্তোলন করতে নিষেধ করা হয়। তারপরও পাথরখেকোদের থামানো যাচ্ছে না। তবে ইতোমধ্যে পাথররাজ্যের অনেক অংশকেই নিষিদ্ধ বোমা মেশিনশূন্য (পাথর উত্তোলন যন্ত্র) করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক এম. কাজী এমদাদুল ইসলাম ইজারাবিহীন এলাকা থেকে কেন পাথর তুলবে- প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে। বারবার অভিযান হচ্ছে, মামলা হচ্ছে। তার পরও ওদের থামানো যাচ্ছে না। জরুরি বিষয় হলো, লোকজনকে আরও সচেতন হতে হবে। সরকার কোনো পাথর কোয়ারি ইজারা দিয়ে যে রাজস্ব পায়, তার চেয়ে যদি ক্ষতি বেশি হয়, তাহলে এর বিকল্পও ভাবতে হবে।’