আলোচিত ওসি প্রদীপ কুমার দাশের স্ত্রী চুমকি দাশকে তার বাবা চট্টগ্রাম শহরের ছয় তলা একটি বাড়ি দানপত্র করে দেন। তবে দুদকের অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছে, আসলে বাড়িটি প্রদীপেরই কেনা, তিনি সেটা শ্বশুরের নামে কিনে আবার স্ত্রীর নামে ফেরত নিয়েছেন।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা প্রদীপের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় ‘অবৈধ অর্থ বৈধ’ করার এই নজির দেওয়া হয়েছে।
‘ঘুষ-দুর্নীতির‘ অর্থে কীভাবে তিনি স্ত্রীর নামে বিভিন্ন সম্পদ গড়েছেন, তা বলা হয়েছে মামলার এজাহারে। বলা হয়েছে, প্রদীপ তার স্ত্রীকে কমিশন ব্যবসায়ী ও মৎস্য ব্যবসায়ী সাজিয়ে ‘অবৈধ সম্পদ বৈধ’ করার চেষ্টা করেছেন।
রোববার দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-১ এ সংস্থাটির সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন বাদী হয়ে প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকির নামে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলাটি করেন। মামলায় চুমকির নামে প্রায় ৪ কোটি টাকার সম্পদ পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এজাহারে বলা হয়, আসামি চুমকি ২০১৩ সালে চট্টগ্রামের কোতোয়ালির পাথরঘাটা এলাকায় জমিসহ একটি ছয়তলা বাড়ি তার বাবা দানপত্র দলিল করে দিয়েছে বলে ঘোষণা দেন।
বাড়িটি যে আসলে প্রদীপের টাকায় কে না, সেই সন্দেহ কেন?
এজাহারে বলা হয়, “চুমকির পিতা বাড়িটি দানপত্র করে দিলেও তার অন্য দুই ভাই ও এক বোনকে কোনো বাড়ি দান করেননি। অথচ তার দুই ছেলের নামে উল্লেখযোগ্য কোনো সম্পদও নেই। এতে প্রতীয়মান হয় যে, ওসি প্রদীপ কুমার দাশ তার ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ গোপন করতে তার শ্বশুরের নামে বাড়ি নির্মাণ করে পরে তার স্ত্রীর নামে দানপত্র করে নিয়ে ভোগ দখল করছেন।”
চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর সারোয়াতলীর ছেলে প্রদীপ প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময়ের চাকরি জীবনে বেশিরভাগ সময় ঘুরে ফিরে চট্টগ্রাম নগর পুলিশ (সিএমপি) ও কক্সবাজার জেলা পুলিশে ছিলেন।
২০০৪ সালে সিএমপির কোতোয়ালি থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) থাকাকালে পাথরঘাটা এলাকায় জায়গা দখলকে কেন্দ্র করে সাময়িকভাবে বরখাস্তও হন এই পুলিশ কর্মকর্তা। সৎ বোনের সম্পত্তি দখলের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
কক্সবাজার সদর থানায়ও একটি জায়গা দখলকে কেন্দ্র করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয় টেকনাফের সাবেক ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে। কক্সবাজারে মাদক পাচার, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারার ভয় দেখিয়ে অর্থ নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
দুদকের মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, চুমকি একজন গৃহিনী হলেও তাকে কমিশন ব্যবসায়ী ও মৎস্য ব্যবসায়ী হিসেবে সম্পদের মালিক হচ্ছিলেন।
“চুমকি কমিশন ব্যবসায়ী হিসেবে ২০১৩-১৪ অর্থ বছর প্রথম আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন। পরবর্তীতে মৎস্য ব্যবসা ও বাড়ি ভাড়া থেকে আয় দেখিয়ে আয়কর রিটার্ন দাখিল করে আসছেন। কিন্তু অনুসন্ধানে চুমকির নামে কোনো কমিশন ব্যবসার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।”
এছাড়া ২০১৩ সাল পর্যন্ত চুমকি মৎস্য ব্যবসা থেকে দেড় কোটি টাকা আয়ের হিসাব আয়কর বিবরণিতে উল্লেখ করেন। এর সপক্ষে ২০০২ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে পাঁচটি পুকুর নগদ সাড়ে ১৬ লাখ টাকায় ১০ বছরের জন্য ইজারা নেওয়ার চুক্তিপত্র দুদকে দাখিল করেন।
“কিন্তু দুদক যাচাই করে দেখে, চুমকি একজন গৃহিনী এবং তার স্বামী ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ১৯৯৫ সালে এসআই হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। ২০০২ সালে তার বা তার স্বামীর ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা সঞ্চয় ছিল না।”
এছাড়া প্রদীপের স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব বিবরণীতে মৎস্য ব্যবসা সম্পর্কিত কোনো লেনদেন না পাওয়ার কথাও মামলায় উল্লেখ করেছে দুদক।
“এতে প্রমাণিত হয় যে আসামি চুমকি মৎস্য ব্যবসা থেকে কোনো আয় করেননি। তিনি তার স্বামী প্রদীপ কুমার দাশের অপরাধলব্ধ অর্থ স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রূপান্তর করার অসৎ উদ্দেশ্যে ভুয়া মৎস্য ব্যবসা প্রদর্শন করে উক্ত আয় দেখিয়েছেন।”
চুমকির সব মিলিয়ে ৩ কোটি ৯৫ লাখ পাঁচ হাজার ৬৩৫ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে এজাহারে বলা হয়।
“তার আয়ের উৎসের সাথে অসংগতিপূর্ণভাবে তার স্বামী ওসি প্রদীপ কুমার দাশের ‘ঘুষ ও দুর্নীতি’ মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ একে অপরের সহযোগিতায় ভোগ দখলে রেখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।”
এই সম্পদের পুরোটাই চুমকির নামে হওয়ায় তাকেই প্রধান আসামি করা হয়েছে।
তবে প্রদীপের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আরেকটি অনুসন্ধান চলছে বলে জানান দুদক কর্মকর্তা রিয়াজ উদ্দিন।
গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হন। এ ঘটনায় তার বোন শাহরিয়া শারমিন ফেরদৌস নয় পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
মামলার পর টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ সাত পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন।
এই ঘটনায় আলোচনায় উঠে আসার পর দুদক প্রদীপকে নিয়ে অনুসন্ধানে নামে।