প্লাজমা থেরাপি’র ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি।
এই বিষয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল (কোভিট ইউনিট)-এর আইসিইউ কনসালটেন্ট ডা. মোহাম্মদ আহাদ হোসেন।
জনসচেতনতা বাড়ানো এবং সাধারন মানুষকে এ বিষয়ে সঠিক ধারণা দিতেই আজকের লেখা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ‘রেফারেন্স’ অনুসরণ করার চেষ্টা করা হয়েছে।
প্লাজমা কী?
প্লাজমা হল আমাদের রক্তের একটি অংশ। রক্তের লোহিত, শ্বেত ও অনুচক্রিকা বাদ দিলে যা থাকে তাই প্লাজমা। এর ৯৩ শতাংশ পানি এবং ৭ শতাংশ অন্যান্য উপাদান, যাদের মধ্যে আছে বিভিন্ন প্রোটিন যেমন- ইমিউনোগ্লোবিন বা অ্যান্টিবডি, ক্লটিং ফ্যাক্টর বা রক্ত জমাট বাঁধার উপাদান ও অন্যান্য কিছু উপাদান।
এই অ্যান্টিবডি অংশটাই কোভিড-১৯’য়ে আক্রান্ত রোগীর শরীরে কাজে লাগে।
প্লাজমা থেরাপি
প্লাজমা থেরাপি নতুন কিছু নয়। প্রায় ১০০ বছর আগে থেকেই এই থেরাপি প্রচলিত আছে। এর আগেও রেইবিস, হেপাটাইটিস বি, মিজল্স, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ইবোলা, মার্স, সার্স এসকল জীবাণু আক্রান্তের সময়ও এই থেরাপি ব্যাবহার হয়েছে।
মূলত এটা শরীর থেকে জীবাণু অপসারণে ভূমিকা রাখে।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে যেভাবে কাজ করে
যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের শরীরে দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর এক ধরনের অ্যান্টিবডি তৈরি হয় যাকে বলে নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি। যা কিনা ‘দি এনজাইম লিঙ্কড ইমিউনোসরবেন্ট অ্যাসে’ বা ‘এলাইসা’ পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের এ ধরনের অ্যান্টিবডি তৈরি হয় তাদের কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস ওই জীবাণুর মাধ্যমে পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে প্লাজমা থেরাপিতে বেশ কিছু অতিরিক্ত অসুস্থ করোনা-রোগী সুস্থ হয়েছেন বা জীবাণু মুক্ত হয়েছেন।
আরও দেখা গেছে যারা ‘লাইফ সাপোর্ট’য়ে আছেন তাদের থেকে অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ অসুস্থ করোনা-রোগী তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়েছেন।
আমাদের দেশেও এই থেরাপি ভালো কাজ করছে বলে চিকিৎসকরা মত প্রকাশ করেছেন।
ঝুঁকির পরিমাণ
রক্ত বা অন্যান্য উপাদান মানব শরীরে প্রবেশে যে ঝুঁকি থাকে এক্ষেত্রেও সেরকম ঝুঁকি রয়েছে। যেমন- অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন, ‘ট্রান্সফিউশন অ্যাসোসিয়েটেড সার্কুলেটরি ওভারলোডেড (টাকো), ‘ট্রান্সফিউশন অ্যাসোসিয়েটেড অ্যাক্যুট নাঙ ইঞ্জুরি’ (ট্রেইল), ফুসফুসের ক্ষতি।
আর করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে ফুসফুসেই সংক্রমণ হয়। তাই নিশ্চিত না হয়ে বা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনোভাবেই এটা দেওয়া যাবে না।
তবে আশার কথা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি তথ্য বলেছে তারা ৫ হাজার রোগীর মধ্যে ৭ হাজার ইউনিট প্লাজমা নিরাপদেই দিতে পেরেছেন।
এখানে আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে- প্লাজমা দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু নিয়ম জড়িত থাকে।
যেমন- ডোনার নিরাপদ কিনা, সংগ্রহ করার নিরাপদ কিনা, সঠিকভাবে সংরক্ষণ হয়েছে কিনা, যিনি দিচ্ছেন সঠিক ভাবে দিচ্ছেন কিনা ইত্যাদি।
সকল স্তরে নিরাপত্তা নিশিত হয়েই এটা দিতে হবে তা-না হলে উপকারের চেয়ে ক্ষতিও হতে পারে। এক্ষেত্রে শরীরের বাইরে থেকে একটি এজেন্ট শরীরে ঢুকালে উল্লেখিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা সঠিকভাবে না অনুসরণ করলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বিপরীত প্রতিক্রিয়া করতে পারে। ফলে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
একজন প্লাজমা দাতা কতবার কতটুকু প্লাজমা দিতে পারবে
প্লাজমা প্রদানের ক্ষেত্রে রক্তের কণিকাগুলো বাদ দিয়ে বাকি প্রোটিনগুলো নেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে শরীর স্বাভাবিক ভাবে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এই ঘাটতি পূরণ করতে সক্ষম হয়।
যে কারণে আমেরিকার ফেডারেল ড্রাগ অ্যাডমিন্সট্রেইশন (এফডিএ) সাত দিনে দুইবার প্লাজমা দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে।
তবে দ্বিতীয়বার দেওয়ার মধ্যে অন্তত এক দিন সময়ের ব্যাবধান থাকার কথা বলেছে।
অবশ্য রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি সপ্তাহে একবার প্লাজমা ডোনেশন নিচ্ছে।
এক্ষেত্রে আমরা বুঝতে পারি আমরা একাধিকবারও প্লাজমা দিতে পারি। একবারে কী পরিমাণ প্লাজমা দিতে পারবে সেটা ডোনারের বয়স ওজন ও অন্যান্য অবস্থার ওপর চিকিৎসক নির্ধারণ করবে।
কোন ধরনের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর জন্য প্লাজমা দরকার?
* হাসপাতালে ভর্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী। * রোগের অবস্থা গুরুতর। শ্বাস কষ্ট। * শ্বাস প্রশ্বাসের হার মিনিটে ৩০ বা তার অধিক। * অক্সিজেন স্যাচুরেইশন ৯৩ বা তার কম। * বুকের এক্স-রে’তে ৫০ ভাগের বেশি অক্রান্ত হওয়া। * মারাত্মক খারাপ অবস্থা বা জীবন সংক্টপূর্ণ। * রেসপিরাটরি ফেইলুয়ার বা শ্বাসযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া। * ‘সেপ্টিক শক’। * বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অকার্যকর হওয়া।
যারা প্লাজমা দিতে পারবেন
– করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী যিনি ‘ন্যাজাল সোয়াব’-এর পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছেন।
অথবা, যিনি টেস্ট করতে পারেননি, কিন্তু করোনা সন্দেহভাজন ছিলেন এবং পরে অ্যান্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে।
– করোনাভাইরাসের লক্ষণগুলো সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হওয়ার ১৪ দিন পর। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে শুধু নেগেটিভ টেস্টের মাধ্যমে-ই নিশ্চিত ভাবে ডোনার নেওয়া যাবে না।
– গর্ভবতী কোনো মহিলার প্লাজমা নেওয়া যাবে না। প্লাজমা নিতে হলে তার প্রেগন্যন্সি টেস্ট নেগেটিভ হতে হবে।
– পুরুষ বা মহিলা ডোনার ‘এইচএলএ অ্যান্টিবডি টেস্ট’ নেগেটিভ হতে হবে।
– ডোনারের অবশ্যই সিফিলিস, হেপাটাইটিস এবং এইচআইভি (এইডস)-এর স্ক্রিনিং টেস্ট করে নিতে হবে।
– ডোনারের সামাজিক ও ভ্রমণের ইতিহাস জেনে নিতে হবে।
প্লাজমা ডোনেশন কি নিরাপদ?
আমরা যারা নিয়োমিত রক্ত দেই তারা যেমন নিরাপদ থাকেন, প্লাজমা ডোনেশনও সেই রকম নিরাপদ। এই প্রক্রিয়ায় যে সমস্ত ব্যাগ, টিউব ব্যবহার হয় সেগুলো একজন রোগীর জন্য একবারের জন্যও জীবাণু মুক্ত উপকরণ ব্যবহার হয়। তাই নিরাপদেই প্লাজমা দেওয়া যায়।
ডায়াবেটিস রোগী প্লাজমা দিতে পারবে কি-না?
এটা ডায়াবেটিস রোগীর ধরন বা তিনি কী ধরনের ওষুধ খাচ্ছেন। তার কোনো ডায়াবেটিস জনিত জটিলতা আছে কিনা। এসকল বিষয় নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি প্লাজমা দিতে পারবেন কিনা।
পরিশেষে বলতে চাই প্লাজমা করোনাভাইরাস চিকিৎসায় একটি নতুন দিক উন্মোচন করেছে। তবে নিরাপদ প্লাজমা দেওয়া-নেওয়া নিশ্চিত করতে রেজিস্টার্ড বা নিবন্ধিত কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।