স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকেই করোনাভাইরাস মহামারীর ‘মূল বোঝার’ মুখোমুখি হতে হচ্ছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এটা এখন আর কেবল স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটে রূপ নিয়েছে।
বুধবার সুইজারল্যান্ডের জেনিভা থেকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) আয়োজিত ভার্চুয়াল বৈশ্বিক সম্মেলনে যোগ দিয়ে তিনি একথা বলেন। বিশ্বের ৮০টির বেশি দেশের নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসসহ বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই অনলাইন সম্মেলনে যোগ দেন।
কোভিড-১৯ মহামারী বাংলাদেশের মতো দেশগুলো, বিশেষত শ্রমিকদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “বিশ্বব্যাপী এই বিপর্যয় এখন বিশ্বায়ন ও যোগাযোগের মূল ভিত্তিকে হুমকির মুখে ফেলেছে, যা আমরা দীর্ঘ সময় ধরে অনেক যত্নে গড়ে তুলেছিলাম। এটি এখন কেবল স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সঙ্কটে পরিণত হয়েছে।”
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, “অন্যান্য সঙ্কটের মতো এলডিসি ও উন্নয়নশীল দেশগুলোই কোভিড-১৯ মহামারীর মূল বোঝার মুখোমুখি হচ্ছে, যদিও এই সংকট তাদের দিয়ে শুরু হয়নি।
“এই মহামারীর কারণে আমাদের দেশীয় ও বৈদেশিক সরবরাহ চেইনগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা কয়েক বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আদেশ হারিয়েছি, আমাদের অনেক শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে এবং লক্ষ লক্ষ শ্রমিক তাদের চাকরি হারিয়েছে।”
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের ক্ষুদ্রশিল্প তাদের বেশিরভাগ সম্পদ ও বাজার হারিয়েছে এবং সর্বোপরি সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে কৃষি ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে।
“এর উপর আমরা মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছি।”
বক্তব্যে করোনাভাইরাস সংকট মোকাবেলায় বিভিন্ন খাতে সরকারের প্রণোদনা প্রদান এবং দুর্গতদের সহায়তায় নগদ অর্থ ও ত্রাণ সামগ্রী দেওয়াসহ সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
মহামারীর কারণে বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের ব্যাপক হারে চাকুরি হারানো এবং এর ফলে রেমিটেন্স কমার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এসডিজি অর্জনে রেমিটেন্স একটি মূল উপাদান হওয়ায় এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।
“বর্তমানে এই চাকরিবিহীন শ্রমিকদের প্রত্যাবাসন এক বিশাল চ্যালেঞ্জ হিসাবে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব ব্যাংক ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে, আমরা ২০ শতাংশের বেশি রেমিটেন্স আয় হারাব।”
অভিবাসীদের ওপর কোভিড-১৯ মহামারীর ক্ষতিকর প্রভাব সামলে নিতে সব দেশের অংশগ্রহণে একটি ‘বলিষ্ঠ বৈশ্বিক পদক্ষেপের’ আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “ভাইরাসটি কাউকেই ছাড় দেয় না। তবে এর ক্ষতিকর প্রভাগুলো ঝুঁকিপূর্ণ লোকজন বিশেষত অভিবাসী ও মহিলা শ্রমিকদের ওপর মারাত্মক ক্ষতির সৃষ্টি করেছে।
“আমাকে অবশ্যই বলতে হবে যে, এখন সব দেশ, সব আন্তর্জাতিক সংস্থা, সুশীল সমাজ সংগঠন এবং বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি জোরাল ও সুসংহত বৈশ্বিক পদক্ষেপ প্রয়োজন।”
‘গ্লোবাল লিডারস ডে’তে বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য এই বিশ্ব ফোরামে তিনটি প্রস্তাব তুলে ধরেন-
# এই সংকটের সময়ে বিদেশের শ্রমবাজারগুলোতে অভিবাসী কর্মীদের চাকরি বজায় রাখতে হবে।
# প্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ এবং অন্যান্য সুবিধা পুরোপুরি প্রদান করার পাশাপাশি তাদের সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যসুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
# মহামারীর পরে অর্থনীতির চাকা আবারও সক্রিয় করার জন্য এই শ্রমিকদের পুনঃনিয়োগ দিতে হবে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এই পরিস্থিতিতে আমরা আইএলওর শতবর্ষের ঘোষণার কথা স্মরণ করতে পারি, যেখানে আমরা সকলেই প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, জনসংখ্যা স্থানান্তর, জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্বায়নের মাধ্যমে আমাদের বিশ্বকে রূপান্তরিত করার প্রয়াসকে স্বীকৃতি দিয়েছিলাম।”
তিনি বলেন, জি-৭, জি-২০, ওইসিডি ও আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলোর সমর্থিত সব পুনরুদ্ধার ব্যবস্থার কেন্দ্রে থাকবে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো।
“আমাদের চারপাশে যা কিছু ঘটছে তা দেখে মনে হচ্ছে, সবার জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি এককভাবে পূরণ করা কঠিন হবে। তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আমরা একযোগে এটি করতে পারব।”
আইএলওর মহাপরিচালক গাই রাইডার এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। জাতিসংঘের মহাসচিব ছাড়াও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম গ্যাব্রিয়েসাস এবং সুইজারল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা, আয়ারল্যান্ড, ফিজি, থাইল্যান্ড, নেপাল, সামোয়া, পাকিস্তান, মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মহাপরিচালক ও আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন।