বাবার জন্য তুবার মন খারাপ। আজ এক বছর পর বাবা দেশে আসলেন, অথচ তার কাছে যাওয়া হলো না।
বাবা ওর জন্য একজোড়া সাদা জুতো এনেছেন। একটা হলুদ পরির মতো পুতুল এনেছেন, চকলেট এনেছেন অনেকগুলো। এসব সামনে নিয়ে খাটে বসে আছে তুবা। কিছুতেই ভুলতে পারে না বাবার করুণ মুখটা।
ওরা বাবাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেলো হাসপাতালের লোকেরা। তুবাকে কোলে নিতে দিলোই না, মায়ের সঙ্গেও কথা বলতে দিলো না। মায়ের চোখে জল ছিলো। তুবাও কেঁদেছে খুব।
বিমানবন্দরে তুবাকে বাবা শুধু বলেছেন- তুমি কান্না করো না মা, আমি তাড়াতাড়িই ফিরে আসবো। মাকে বললেন- মেয়েটাকে সাবধানে নিয়ে যাও, খুব সাবধানে থাকবে। করোনাভাইরাস কিন্তু সাংঘাতিক জীবাণু। আরো কিছু বলতে চাইছিলেন বাবা। কিন্তু লোকগুলো তাকে নিয়ে গেলো। কাঁদতে কাঁদতেই তুবাকে নিয়ে বাসায় ফিরেছে মা। গাড়িতে বসে মেয়েকে বোঝালেন তিনি।
একটা ভয়ানক জীবাণু ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীতে। তার নাম ‘করোনাভাইরাস’, এই জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে প্রথমে জ্বর ও কাশি বাঁধায়। তারপর আরো কঠিন ও শক্তিশালী হয়ে যেতে পারে এই জীবাণু।
চীন থেকে এটা ছড়িয়েছে সবখানে। এ জীবাণুতে আক্রান্ত হয়ে অনেকেই মারা গেছে। আবার চিকিৎসা নিয়ে সুস্থও হয়েছে অনেকে। ভয়ের বিষয় হলো এটা খুবই ছোঁয়াচে জীবাণু। একজনের হলে তার সঙ্গে যারা থাকে তাদেরও হয়ে যেতে পারে। তাই পরিবারের কারো হলে তাকে পরিবার থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হয়।
আমার বাবাকে কি এই পাজি জীবাণু ধরেছে মা? জানতে চেয়েছিলো তুবা। জবাবে মা বলেছেন- তোমার বাবার ঠাণ্ডা জ্বর হয়েছে। সঙ্গে কাশিও আছে। উনি তো ইতালি থেকে এসেছেন। সেখানে অনেক মানুষ এ জীবাণুতে আক্রান্ত। তাই সন্দেহ করা হচ্ছে যে তারও এটা হতে পারে।
সাবধানতার জন্য তাকে হাসপাতালের কোয়ারিন্টেশনে রাখা হবে কিছুদিন। যদি তার শরীরে এ জীবাণু পাওয়া যায় তবে চিকিৎসা করা হবে। আর না পেলে কয়েকদিন পরে এমনিতেই চলে আসবে।
ছোট্ট তুবা মাত্র ক্লাস থ্রিতে পড়ে। তবু সে অনেক কথাই সহজে বুঝে ফেলে। করোনাভাইরাসের বিষয়টা বুঝতেও ওর কোন সমস্যা হলো না। বাসায় এসে বাবার লাগেজ থেকে খেলনা ও চকলেট বের করে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে রেখে দেয়। বাবাকে ছাড়া কিছুতেই ভালো লাগে না ওর। বাবার কথা মনে পড়ে। বাবা দেশে আসলেই প্রতি রাতে তুবাকে গল্প শোনায়।
বাবার গল্পের কথা মনে পড়ছে তুবার। রাক্ষসের গল্প। এক রাজ্যে অনেকগুলো রাক্ষস আক্রমণ করেছিলো। সেই দুষ্টু রাক্ষসগুলো মানুষকে ধরে মেরে ফেলতো। সেই রাজ্যের রাজকুমারী রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধ করে সব রাক্ষস মেরে ফেলেছিলো। বাবার বলা গল্পের কথা ভাবতে ভাবতে মন খারাপ করেই ঘুমিয়ে পড়ে তুবা।
তুবা স্বপ্ন দেখে সারাদেশ ছেয়ে গেছে ছোট্ট ছোট্ট রাক্ষসে। রাক্ষসগুলো অনেক মানুষের শরীরে ঢুকে যাচ্ছে। তারা অসুস্থ হয়ে পড়ছে দ্রুত। তুবা ঘোড়ায় চড়ে রাজকুমারীর মতো যুদ্ধ করছে সেই ছোট্ট রাক্ষসগুলোর বিরুদ্ধে। রাক্ষসগুলো ভয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে।
মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙলো তুবার। এ দুপুরবেলা না খেয়ে কেউ ঘুমায়? উঠে গোসল করে এসো। ভাত খাবে। করোনার আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য পরিষ্কার থাকা জরুরি। করোনা রাক্ষস কিভাবে মারা যায় মা? মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে মা বলেন-
আপাতত এটার কোন ওষুধ তৈরি হয়নি। তাই প্রতিরোধ করাই হচ্ছে সমাধান।
বাইরে কোথায় গেলে অবশ্যই মুখে মাস্ক লাগিয়ে যাওয়া উচিত। খুব বেশি জনসমাবেশে না যাওয়াই ভালো। বাইরে থেকে ফিরে সাবান দিয়ে অন্তত বিশ সেকেন্ড হাত ধুতে হবে। ঠাণ্ডা পানি ও ঠাণ্ডা জাতীয় খাবার খাওয়া বন্ধ রাখা উচিত।
কারণ এ ভাইরাস ঠাণ্ডায় নিরাপদে থাকে।
তাই সম্ভব হলে খাবার পানি গরম করে খেতে হবে। মাছ মাংস রান্না করতে হবে খুব বেশি সেদ্ধ করে। ধারণা করা হয় এ ভাইরাস অন্য প্রাণী থেকে এসেছে। তাই অর্ধেক সেদ্ধ বা কাঁচা মাছ মাংস ডিম খাওয়া যাবে না। এভাবে সাবধানে থাকলেই করোনাভাইরাসের হাত থেকে বাঁচা যাবে।
তুবা ভালো করে সাবান মেখে গোসল করলো। ভাত খেলো। তারপর মাকে বললো- আমি করোনা রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধ করবো মা। তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে? মা হেসে বললেন- অবশ্যই করবো। বলো তুমি কী করতে চাও।
তুবা দোকান থেকে অনেকগুলো রঙিন কাগজ কিনে আনে। মাকে সঙ্গে নিয়ে সব কাগজে লেখে করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার উপায়। পরদিন সেগুলো নিয়ে স্কুলে যায়। টিচারের থেকে অনুমতি নিয়ে ওর ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে নেয়। করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার উপায় লেখা কাগজগুলো বন্ধুদের হাতে দেয়। নিজেও নেয় একটা।
তাতে লেখা ছিলো- ‘করোনা হলো ছোট্ট রাক্ষস। এ রাক্ষসদের আমরা তাড়াবোই’।
কাগজ হাতে তুবা ওর বন্ধুদের নিয়ে স্কুলের বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়, যাতে সবাই দেখতে পায় আর সচেতন হয়। তুবার কাণ্ড দেখে ওর স্কুলের সবাই অবাক হয়। এলাকাবাসীও অবাক হয়। দুজন সাংবাদিক এসে ওদের ছবি তোলে। পরদিন পত্রিকায় তুবা আর ওর বন্ধুদের ছবি ছাপা হয়। সে ছবি দেখে অন্য স্কুলের
বাচ্চারাও কাগজে স্লোগান লেখে। করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার সচেতনতামূলক স্লোগান।
করোনা রাক্ষস তাড়াতে সব স্কুলের শিশুরা হয়ে যায় রূপকথার গল্পের রাজকুমার আর রাজকুমারী। এতে অবাক করা ফল পাওয়া যায়। দেশের সবাই সচেতন হয়ে যায়।
এ সচেতনতায় খুব অল্প সময়েই করোনামুক্ত হয় আমাদের দেশ। তুবার বাবাও সুস্থ হয়ে ফিরে আসে বাড়িতে। বাবাকে ফিরে পেয়ে তুবা দৌড়ে যায় তার কাছে। বাবা বুকের কাছে জড়িয়ে নেয় ছোট্ট রাক্ষস তাড়ানো রাজকুমারীকে।