বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর প্রথম ৫০ হাজার রোগী শনাক্ত হয়েছিল ৮৭ দিনের মাথায়; এরপর তা লাখে পৌঁছাতে সময় লেগেছে মাত্র ১৬ দিন।
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় বাংলাদেশে দুই মাসের বেশি সময় লকডাউনের পর বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছিল গত ৩১ মার্চ। এরপরের ১৮ দিনে ৫৫ হাজারের বেশি কোভিড-১৯ রোগী শনাক্তের তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, যা মোট শনাক্তের অর্ধেকের বেশি।
সরকারি হিসাবে ১ লাখ ২ হাজারের বেশি শনাক্ত রোগী নিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় ১৭ নম্বরে চলে এসেছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে সংক্রমণ কবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গ্রাফ আবার নিম্নমুখী হবে, সে বিষয়ে এখনও কোনো ধারণা দিতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বৃহস্পতিবার অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে যুক্ত হয়ে বলেছেন, “বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী, করোনা পরিস্থিতি এক, দুই বা তিন মাসে শেষ হচ্ছে না। এটি দুই থেকে তিন বছর বা তার চেয়েও বেশি দিন স্থায়ী হবে, যদিও সংক্রমণের মাত্রা উচ্চহারে নাও থাকতেবাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগীর খোঁজ মেলে গত ৮ মার্চ; তার দশ দিনের মাথায় ঘটে প্রথম মৃত্যু। সংক্রমণ শুরুর পর ৩০তম দিনে ৬ এপ্রিল দেশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যায়।
তখনও করোনাভাইরাস পরীক্ষার সুযোগ কেবল আইইডিসিআরে সীমাবদ্ধা ছিল। পরে সামাজিক সংক্রমণ শুরু হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরীক্ষার সুযোগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। এরপর দেশে আক্রান্তের সংখ্যাও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে।
সংক্রমণ পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে শুরু করায় বিশ্বের আরও অনেক দেশের মত বাংলাদেশেও ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয় লকডাউনের বিধিনিষেধ। কিন্তু তা কার্যকর না হওয়ায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে খুব একটা সাফল্য আসেনি।
সংক্রমণ শুরুর পর ৩৮ তম দিনে ১৪ এপ্রিল শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এরপর ২০ দিনের মাথায় ৪ মে রোগীর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়ার খবর জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। প্রথম রোগী শনাক্তের পর সেটা ছিল ৫৮তম দিন।
এরপর ১১ দিনে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ২০ হাজার, তার পরের সাত দিনে ৩০ হাজার এবং তার ছয় দিনে ৪০ হাজার এবং আরও পাঁচ দিনের মাথায় ২ জুন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যায়।
প্রথম রোগী শনাক্তের পর সেটা ছিল ৮৭তম দিন। তার আগেই লকডাউনের অধিকাংশ বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছে। প্রথমে পোশাক কারখানা এবং তারপর মার্কেট, শপিং মল আর উপাসনালয় খুলে দেওয়া হয়েছিল রোজার ঈদের আগেই। ৩১ মে থেকে সরকারি ভাষায় ‘সীমিত আকারে’ অফিস এবং যানবাহন চালুর অনুমতি দেওয়া হয়।
২ জুনের পর তিন দিনে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৬০ হাজার এবং তার পরের চারদিনে ৭০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এরপর প্রতি তিন দিনে গড়ে দশ হাজার করে বেড়ে ১৮ জুন বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা লাখের ঘরে পৌঁছায়।
শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি |
সময় লেগেছে |
১-১০০০০ |
৫৮ দিন |
১০০০০-২০০০০ |
১১ দিন |
২০০০০-৩০০০০ |
৭ দিন |
৩০০০০-৪০০০০ |
৬ দিন |
৪০০০০-৫০০০০ |
৫ দিন |
৫০০০০-৬০০০০ |
৩ দিন |
৬০০০০-৭০০০০ |
৪ দিন |
৭০০০০-৮০০০০ |
৩ দিন |
৮০০০০-৯০০০০ |
৩ দিন |
৯০০০০-১০০০ |
৩ দিন |
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৩ হাজার ৮০৩ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়ায় দেশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে ১ লাখ ২ হাজার ২৯২ জন হয়েছে।
আক্রান্তদের মধ্যে আরও ৩৮ জনের মৃত্যুতে দেশে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৩৪৩ জন।
আইডিসিআরের ‘অনুমিত’ হিসাব দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনে বলা হয়, বাসা ও হাসপাতাল মিলিয়ে চিকিৎসাধীন মোট ৪০ হাজার ১৬৪ জন এ পর্যন্ত সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
এ পর্যন্ত দেশে মোট ৫ লাখ ৬৭ হাজার ৫০৩টি নমুনা পরীক্ষা করার তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ১৭ কোটি মানুষের দেশে আরও অনেকে পরীক্ষার বাইরে থেকে যাওয়ায় আক্রান্ত বা মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
দেশে ভাইরাসের বিস্তার
আইইডিসিআর সর্বশেষ ১৬ জুন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে বলছে, দেশে মোট শনাক্ত রোগীর ৪৩ দশমিক ৮৩ শতাংশই ঢাকা মহানগরীর বাসিন্দা। মহানগরের বাইরে ঢাকা জেলার অন্যান্য অংশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা সারা দেশের ২০ দশমিক ৫১ শতাংশ।
এছাড়া ১৯ দশমিক ৭০ শতাংশ রোগী চট্টগ্রাম বিভাগের, ৩ দশমিক ২২ শতাংশ ময়মনসিংহ বিভাগের, ৩ শতাংশ রংপুর বিভাগের, ২ দশমিক ৮০ শতাংশ খুলনা বিভাগের, ২ দশমিক ৭৮ শতাংশ সিলেট বিভাগের, ২ দশমিক ১৩ শতাংশ রাজশাহী বিভাগের, ২ দশমিক ০২ শতাংশ বরিশাল বিভাগের।
ঢাকায় কোথায় কত বিস্তার
আইইডিসিআরের তথ্য বলছে, ১৬ জুন পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীতে সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া গেছে মিরপুরে, সেখানে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ১৭১ জন।
এছাড়া উত্তরায় ৬৭৬ জন, মোহাম্মদপুরে ৫৯২ জন, মুগদায় ৫০১ জন, যাত্রাবাড়ীতে ৪৮৪ জন, ধানমণ্ডিতে ৪৬৯ জন, মগবাজারে ৩৩৩ জন, তেজগাঁওয়ে ৩১৫ জন, রামপুরায় ২৯৬ জন, মহাখালীতে ৫২২ জন ও খিলগাঁওয়ে ২৯৩ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে।
আক্রান্ত বেশি তরুণরা, মৃত্যু বেশি ষাটোর্ধ্বদের
জীবিকার তাগিদে যে বয়স শ্রেণির মানুষকে বাইরে বের হতে হয় সবচেয়ে বেশি, সেই ২১ থেকে ৪০ বছর বয়সীরাই দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান– আইইডিসিআর এর তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত সারা দেশে যে ১ লাখ ২ হাজার ২৯২ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ২৮ শতাংশ রোগীর বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। আর ২৭ শতাংশ রোগীর বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে।
আক্রান্তদের মধ্যে ৩ শতাংশের বয়স ১ থেকে ১০ বছরের মধ্যে, ৭ শতাংশের বয়স ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে, ১৭ শতাংশের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে, ১১ শতাংশের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে এবং বাকি ৭ শতাংশের বয়স ৬০ বছরের বেশি।
দেশে এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১ হাজার ৩৪৩ জন। তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৯ শতাংশের বয়স ৬০ বছরের বেশি।
এছাড়া ২৯ দশমিক ৬২ শতাংশ রোগীর বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে, ১৭ দশমিক ৩৯ শতাংশের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে, ৮ দশমিক ২৯ শতাংশের বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে, ৩ দশমিক ৪ শতাংশের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে, ১ দশমিক ৪৯ শতাংশের বয়স ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে এবং শূন্য দশমিক ৮২ শতাংশের বয়স ১ থেকে ১০ বছরের মধ্যে ছিল।
আইইডিসিআর যে পরিসংখ্যান দিয়েছে, তাতে শনাক্ত রোগীদের মধ্যে ৭১ শতাংশ পুরুষ ও ২৯ শতাংশ নারী। আর মৃতদের মধ্যে ৭৭ শতাংশ পুরুষ ও ২৩ শতাংশ নারী