করোনা ভাইরাসে টালমাটাল পুরোবিশ্ব। বিশ্বের নানা প্রান্তের প্রায় ৭০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯)। প্রাণ হারিয়েছেন তিন হাজার দু’শর বেশি মানুষ। বাংলাদেশের প্রতিবেশী বেশির ভাগ দেশেই করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশও। ইতোমধ্যে দেশে বেশ কয়েকজন করোনা আক্রান্ত হওয়ার গুজব ছড়িয়ে পড়লেও স্বাস্থ্য পরীক্ষায় তার প্রমাণ মেলেনি। সর্বশেষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে দুবাই প্রবাসী এক যুবক সিলেট হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
করোনা ভাইরাস সন্দেহে সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালের (সদর হাসপাতাল) করোনা ইউনিটে ভর্তি দুবাই প্রবাসীর রক্ত পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর খবর সিলেটে ছড়িয়ে পড়লে লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক দেখা যায়। এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস স্ক্রিনিং পরীক্ষা পর্যাপ্ত নয়। করোনা ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণের যেসব ব্যবস্থা তা বাংলাদেশের জন্য সন্তোষজনক নয়। তাই করোনা প্রতিরোধে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা জানতে চেয়েছে হাইকোর্ট। করোনা প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকার কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তা জানানোর আদেশসহ তিনটি নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী ৯ মার্চের মধ্যে আদালত সরকারের সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে অগ্রগতি জানাতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ করোনা ভাইরাসের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতে। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ মোট ২৫ দেশ কভিড-১৯-এর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
বাংলাদেশ ছাড়া বাকি ২৪টি দেশ হলো: আফগানিস্তান, অ্যাঙ্গোলা, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, কাজাখস্তান, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, তাজিকিস্তান, ফিলিপাইন, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, জাম্বিয়া, জিম্বাবুয়ে, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ইথিওপিয়া, কিরঘিজ প্রজাতন্ত্র, লাওস, মঙ্গোলিয়া, নেপাল, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম।
একইভাবে বাংলাদেশের চারপাশে প্রতিবেশী দেশগুলোতে করোনা ভাইরাসের রোগী শনাক্ত হওয়ায় রোগটিকে বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলছে চীনও। ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেছেন, যে কোনো স্থান থেকেই করোনা ভাইরাস আক্রমণ করতে পারে। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশেও করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। সে কারণে বাংলাদেশও ঝুঁকিতে রয়েছে এবং বাংলাদেশের উচিত সতর্ক থাকা। তাই পরশু, কাল বা আজ নয়, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সব বন্দরে (নৌ, স্থল, বিমান) থার্মাল স্ক্যানার বসানো জরুরি।
জাতীয় রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেছেন, চীন থেকে আসা ব্যক্তিদেরই কেবল স্ক্রিনিং করা হচ্ছে গণমাধ্যমে আসা এমন খবর সঠিক নয়। এতে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। হয়তো চীনা রাষ্ট্রদূতের কাছে ভুল তথ্য যেতে পারে, তিনি ভুলবশত বলতে পারেন। এ ব্যাপারে আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে তাদের প্রকৃত তথ্য জানানো হবে।
অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ২১ জানুয়ারি থেকে প্রথমে চীন থেকে আসা বিমানগুলোকে স্ক্রিনিং করা হচ্ছিল। যদিও সেখানে কেবল চীনা নাগরিকরাই ছিলেন না, চীন থেকে আসা সবাইকে স্ক্রিনিং করা হয়েছে। পরে ৭ ফেব্রæয়ারি থেকে যখন লোকাল ট্রান্সমিশন পাওয়া গেল তখন স্থল, সমুদ্র ও বিমান বন্দরসহ সব যানবাহনের যাত্রীদের স্ক্রিনিং করা হয়েছে। এ পর্যন্ত সাড়ে চার লাখের বেশি যাত্রীকে স্ক্রিনিং করা হয়েছে। তিনি জানান, মোংলা বন্দরে একটি জাহাজের তিনজন যাত্রীর মধ্যে করোনার লক্ষণ-উপসর্গ রয়েছে বলে জানা গেছে।
ইতোমধ্যে তাদের থেকে নমুনা সংগ্রহ করার প্রক্রিয়া নেয়া হয়েছে। জাহাজটি গভীর সমুদ্রে রাখা হয়েছে। পুরো বিষয়টি ইনভেস্টিগেশন করে তথ্য জানাতে পারবেন বলে জানান তিনি। এরই মধ্যে মোংলা বন্দরের হারবার মাস্টার কমান্ডার ফকর উদ্দিন জানিয়েছেন, জাহাজটি করোনামুক্ত।
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে গৃহীত ব্যবস্থা জানতে চায় হাইকোর্ট: চীনের উহান থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে সে সম্পর্কে সোমবারের মধ্যে জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। সংবাদ মাধ্যমে এ বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনার পর গতকাল বৃহস্পতিবার বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বে তিনটি মৌখিক নির্দেশনা দেন। আদালতে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবিএম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।
এই তিন দফা নির্দেশনা হচ্ছে: স্থলবন্দর, নৌবন্দর, বিমানবন্দর, বিশেষ করে বিমানবন্দরে যখন বিদেশিরা বাংলাদেশে আগমন করছেন, তখন অভ্যন্তরে প্রবেশের আগে তাদের কি ধরনের পরীক্ষা করা হচ্ছে, যারা পরীক্ষা করছেন তারা প্রশিক্ষিত কিনা এবং যে যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে সেগুলোর সক্ষমতা রয়েছে কিনা তা জানাতে বলেছেন। সারা বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা ভাইরাসের জন্য পৃথক কেবিনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালগুলো এখন পর্যন্ত প্রাক প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। আদালত নির্দেশনা দিয়েছেন, সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি সব বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও করোনা ভাইরাসের জন্য প্রাক প্রস্তুতিমূলক সব ধরনের ব্যবস্থা (পৃথক কেবিনসহ চিকিৎসকের সরঞ্জাম) গ্রহণ করতে হবে।
সিলেটে করোনা ভাইরাস আতঙ্ক, প্রবাসীর রক্ত ঢাকায়: প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটে করোনা ভাইরাস আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে দুবাইপ্রবাসী এক যুবক সিলেট হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। করোনা ভাইরাস সন্দেহে সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালের (সদর হাসপাতাল) করোনা ইউনিটে ভর্তি দুবাই প্রবাসীর রক্ত পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। তবে এসব বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর খবর সিলেটে ছড়িয়ে পড়লে লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক দেখা যায়। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার ইউনুছুর রহমান বলেন, ঢাকায় রোগীর রক্ত পরীক্ষা করা হচ্ছে। আমি নিজেও ঢাকায় এসব বিষয়ে মিটিং করছি। বর্তমানে আমি ঢাকায় আছি। তবে এসব বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই বলেও জানান তিনি।
ইউনুছুর রহমান আরো বলেন, ‘সিলেটবাসীর প্রতি আমাদের পরামর্শ হলো উদ্বিগ্ন না হয়ে ধৈর্যধারণ করা। আমরা সব রকম প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়- দুবাই প্রবাসী কানাইঘাট উপজেলার সুতার গ্রামের হাফিজ আলী হোসেনের ছেলে জাকারিয়া (৩২)। এর আগে ২৯ ফেব্রুয়ারি ওই প্রবাসী দুবাই থেকে দেশে ফেরেন। এরপর তিনি জ্বর, সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হন। এর চিকিৎসা নিতে গত বুধবার দুপুরে তিনি রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে তাকে ঢাকায় যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু তিনি ঢাকায় না গিয়ে নগরের একটি বাসায় অবস্থান করেন। পরে রাতে তিনি সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে দেখেন। তখন তার কাছ থেকে সমস্যাগুলো শোনেন। যেগুলো করোনা ভাইরাসের আক্রান্ত রোগীর সবগুলো লক্ষণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।