করোনায় বৈদেশিক বাণিজ্যে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ

image-363107-1604953810

করোনার প্রভাব মোকাবেলা করে বিশ্ব বাণিজ্য পরিস্থিতি এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। দেশে বৈদেশিক বাণিজ্যও শুরু হয়নি পুরোদমে। এর মধ্যে আসছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ।

ইতোমধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সীমিত আকারে ফের লকডাউন ঘোষণা করছে। চলাচলেও নেয়া হচ্ছে বাড়তি সতর্কতা। এসব কারণে পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আর্থিক খাতও পুরোপুরি চালু না হওয়ায় লেনদেন ব্যাহত হচ্ছে। এসব মিলে বৈদেশিক বাণিজ্যে দেখা দিয়েছে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ।

এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পণ্যের উৎপাদন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা এবং সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি করা। ব্যাংকিং যোগাযোগ পুরোদমে চালু করা, আর্থিক লেনদেনের গতি বাড়ানো। ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করার মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এছাড়া বিনিয়োগ বাড়ানো ও নতুন শিল্পকারখানা স্থাপনেও উদ্যোক্তারা অনিশ্চয়তায় পড়েছেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বৈদেশিক ও দেশীয় বাণিজ্য স্বাভাবিক হবে না। করোনার থাবা থেকে অর্থনীতি উদ্ধার করতে দরকার একটি রোডম্যাপ, যা এখন পর্যন্ত কোনো দেশই করতে পারেনি। এ অবস্থায় ভোক্তারা জরুরি প্রয়োজন ছাড়া অন্য কেনাকাটা থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন।

ফলে পণ্য উৎপাদন করেও বিক্রি করা যাচ্ছে না। আবার করোনার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় পণ্যের চাহিদা যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে সরবরাহ। একইসঙ্গে কমেছে উৎপাদন। এসব মিলে অর্থনীতিকে মন্দায় ফেলেছে। এ থেকে উদ্ধার পেতে হলে করোনায় নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। সেটি সম্ভব হচ্ছে না। ফলে করোনার কারণে অর্থনীতিতে সৃষ্ট বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই এগোতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

গত ডিসেম্বর থেকে চীনে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়। ফেব্রুয়ারিতে তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশেও আঘাত করে। ফলে গত মার্চ থেকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়। ১৫ মার্চ থেকে মে পর্যন্ত ব্যবসাবাণিজ্য স্থবির ছিল।

পরে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে। কিন্তু এখনও পুরো স্বাভাবিক হয়নি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, মিলনায়তন খোলেনি, পর্যটন খাত স্বাভাবিক হয়নি। যোগাযোগ ব্যবস্থায় যাত্রী কম, বিনোদনের ব্যবস্থাগুলো সচল হয়নি। আবাসিক হোটেল ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ও একই অবস্থা। বিদেশি ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনও হোম অফিস বা বাড়িতে বসে কাজ চলছে।

বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ সীমিত। বিমান, স্থল, নৌ ও সমুদ্রপথে যোগাযোগ অনেক কম। এতে আমদানি-রফতানি যেমন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি ব্যাহত হচ্ছে পর্যটন। অথচ এ দুটি খাতই বিশ্ব জিডিপিতে প্রায় ৩০ শতাংশ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে এ দুটি খাতের ভূমিকা গড়ে প্রায় ২৫ শতাংশ।

একক দেশ হিসাবে চীনের সঙ্গেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য রয়েছে। এরপরেই আছে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। অঞ্চল হিসাবে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর সঙ্গে। বাংলাদেশের মোট আমদানির ২৬ শতাংশ এবং রফতানির ৩ শতাংশ হয় চীনের সঙ্গে। মোট রফতানির ২৬ শতাংশ এবং আমদানির সাড়ে ৩ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে।

মোট আমদানির সাড়ে ১৪ শতাংশ ও রফতানির ৩ শতাংশ হয় ভারতের সঙ্গে। মোট রফতানির ৫৬ শতাংশ এবং আমদানির ৮ শতাংশ হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে। চীনের সঙ্গে ইতোমধ্যে বাণিজ্য প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কিন্তু অন্য দেশগুলোর সঙ্গে এখনও স্বাভাবিক হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে এখনও করোনার ভয়াল থাবা অব্যাহত। গত মার্চ থেকে এ পর্যন্ত দেশটিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা চলছে।

তবে লকডাউন শিথিল করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে করোনার প্রকোপ কমলেও এখন আবার দ্বিতীয় হানা আসছে আরও ভয়াল রূপে। এর মধ্যে স্পেনে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। ফ্রান্সে সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত কারফিউ আরোপ, ইতালিতে অঞ্চলভেদে হচ্ছে লকডাউন, যুক্তরাজ্যেও সীমিত আকারে লকডাউন আরোপ করা হয়েছে।

করোনার শুরুতে প্রায় ৬ লাখ প্রবাসী দেশে এসেছেন। তারাও এখন যেতে পারছেন না। কেননা বাংলাদেশ থেকে যেতে অনেক দেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কয়েকটি দেশ ছাড়া প্রায় সবাই পর্যটনের ভিসা দেয়া বন্ধ রেখেছে। ভারত সীমিত আকারে চিকিৎসা ও ব্যবসায়ীদের ভিসা দিচ্ছে। পর্যটন ভিসা বন্ধ।

এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে বলা হয়েছে, করোনায় দেশের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। ফলে তাদের ভোগের মাত্রাও কমেছে। এজন্য কমেছে অভ্যন্তরীণ চাহিদা। এতে ভোগ্যপণ্য আমদানি কমেছে। একই অবস্থা বিদেশে। ফলে দেশের রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, করোনার প্রভাবে আমদানিতে মন্দা অব্যাহত রয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট এই আট মাসের মধ্যে শুধু এক মাস অর্থাৎ জুনে আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বাকি সাত মাসই আমদানি কমেছে। এর মধ্যে করোনার প্রভাবে এপ্রিলে আমদানি কমেছে সোয়া ৪৪ শতাংশ। মে মাসে কমেছে ৩১ শতাংশ। জুনে বেড়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ। অর্থাৎ আগের দুই মাসে ৭৫ শতাংশ কমে পরের মাসে বেড়েছে ২৪ শতাংশ। এর মানে এখনও আমদানি নেতিবাচক। জুলাই ও আগস্টে কমেছে ২৬ শতাংশ।

বছরের শুরতেই রফতানিতে মন্দাভাব ছিল। মার্চে কমেছিল ১৮ শতাংশ। এপ্রিলে এসে তা ৮৩ শতাংশ কমে যায়। মে মাসে কমে ৬২ শতাংশ। জুনে আড়াই শতাংশ। এত কমার পর গত তিন মাস ধরে সাড়ে ৪ থেকে সাড়ে ৩ শতাংশ করে বাড়ছে। পরিমাণে রফতানি আয় এখনও কম।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, বাংলাদেশের একটি বড় সুবিধা হচ্ছে কম দামের পণ্য রফতানি করে। এগুলোর চাহিদা সব সময়ই থাকে। অর্থনৈতিক মন্দায় বেশি দামের পণ্যের ক্রেতারা এখন কম দামের পণ্যে আগ্রহী হবে। এছাড়া কম দামের ক্রেতারা তো কিনবেই। ফলে রফতানিতে খুব বড় আঘাত আসবে না।

রেমিটেন্সে এখনও করোনার প্রভাব পড়েনি। বরং রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে। যদিও প্রায় ৬ লাখ প্রবাসী বিদেশ থেকে দেশে চলে এসেছেন। এখন আর যেতে পারছেন না। একই সঙ্গে নতুন শ্রমিকরাও যেতে পারছেন না। ফলে আগামীতে রেমিটেন্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।

এদিকে রেমিটেন্স, রফতানি আয় ও বৈদেশিক ঋণ ছাড় হওয়ায় সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা আয় বেড়েছে। অন্যদিকে আমদানি ব্যয় কমা ও বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর ফলে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় কম হচ্ছে। এতে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ছে।

Pin It