করোনা দুর্যোগেও বিতর্কে তিন এমপি, বিব্রত সরকার

66620200622011842

চীনের উহান থেকে জেগে উঠে পুরো পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে করোনা ভাইরাস। বাংলাদেশেও এই প্রাণঘাতী ভাইরাস জেঁকে বসেছে। তছনছ হয়ে গেছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে মানুষের প্রাত্যহিক জীবন। চাকরি ব্যবসা হারিয়ে মানুষ দিশেহারা।

এ অবস্থায় মানুষের জীবন জীবিকা স্বাভাবিক রাখতে সরকার যখন বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে ব্যস্ত, তখন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে মেতে আছেন তিন জনপ্রতিনিধি। সে কারণে তাদের নিয়ে বয়ে যাচ্ছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। তাদের মধ্যে একজনের কর্মকাণ্ডে আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তিনি লক্ষ্মীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র এমপি কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল।

অর্থ ও মানব পাচারের মতো জঘন্য অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে কুয়েতে গ্রেফতার হয়েছেন এমপি পাপুল। এ ঘটনা বিশ্ব মিডিয়ায় ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। ফলে বিশ্বজুড়ে দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, শুধু টাকা বিলিয়ে অপরাধ জগতের চিহ্নিত মাফিয়া কিভাবে জাতীয় সংসদ সদস্যের পদটি পর্যন্ত বাগিয়ে নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, অদৃশ্য জাদুর ছোঁয়ায় পাপুল তার স্ত্রীকেও বানিয়েছেন সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য। উভয়েই দেশ থেকে শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচারের পাশাপাশি মানব পাচারের জঘন্য বাণিজ্য ফেঁদে বসেছেন।

এমপি পাপুল ও এমপি সেলিনা ইসলাম দম্পতির মাফিয়া সিন্ডিকেট মাত্র ৭-৮ বছরেই বাংলাদেশ থেকে ২০ হাজারের বেশি নারী-পুরুষকে বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন বলেও অভিযোগ আছে।

সমালোচনার তুঙ্গে থাকা অন্য দুইজন হলেন মানিকগঞ্জ-১ আসনের এমপি নাঈমুর রহমান দুর্জয় এবং রাজশাহী-৪ আসনের এমপি এনামুল হক। তারা দুজনেই সরকার দলীয়। গণমানুষের দুর্দিনেও তারা জড়িয়ে পড়েছেন নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে। তাদের আত্মীয়-স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনরাও করে বেড়াচ্ছেন না অপকর্ম।

পাপিয়াকাণ্ডে জড়িয়ে গেছে এমপি নাইমুর রহমান দুর্জয়ের নাম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে ঘিরে ব্যাপক বিতর্ক চলছে।

অন্যদিকে রাজশাহী-৪ আসন থেকে নির্বাচিত সরকারদলীয় এমপি এনামুল হকের নারীঘটিত কেলেঙ্কারীর ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড়। কয়েক দফা নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্যের ব্যক্তিগত জীবনের ক্লেদাক্ত ঘটনা দলের ভেতরে বাইরে নানারকম সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন।

মানবপাচারকারী এমপি নিয়ে বিব্রত সরকার:
কুয়েতে অর্থ ও মানবপাচার মামলায় অভিযুক্ত হয়ে সে দেশের গোয়েন্দা পুলিশের হাতে আটক ও রিমান্ড শেষে কারাগারে রয়েছেন লক্ষীপুর-২ আসনের এমপি কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল। অর্থ ও মানব পাচারের বিরুদ্ধে বিশ্ব যখন অভিন্ন সুরে কথা বলছে, তখন এমন অপরাধের সঙ্গে বাংলাদেশের একজন আইন প্রণেতার জড়িত থাকার বিষয় এখন ‍আন্তর্জ‍াতিক ‍অঙ্গনে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে।

এমপি হওয়ার তিন বছর আগেও তাকে কখনো এলাকায় দেখা যায়নি। একদিনও রাজপথে মিছিল মিটিং করতে হয়নি। সেই ব্যক্তি ও তার স্ত্রীর এমপি হওয়া রূপকথার গল্পের মতোই। জন্মের পর পাপুল ঢাকা ও চট্টগ্রামে শৈশব-কৈশোর কাটিয়ে ১৯৯২ সালে তার ভাই বিএনপি নেতা কাজী মঞ্জুরুল আলমের হাত ধরেই মরুভূমির দেশ কুয়েতে পাড়ি জমান। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দেড়-দুই বছর আগে ২০১৬ সালে লক্ষ্মীপুরে হঠাৎ আবির্ভূত হন তিনি।

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন জোটাতে ব্যর্থ হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেই ভোটযুদ্ধে নামেন তিনি। লক্ষীপুর-২ আসনটি আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিলে সেখানে জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি মোহাম্মদ নোমান মহাজোটের প্রার্থী হন। পরবর্তী সময়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সহায়তা নিয়ে এবং মহাজোট প্রার্থীর সঙ্গে গোপন সমঝোতা করে টাকার জোরে এমপির মুকুট ছিনিয়ে নেন পাপুল। এরপর স্ত্রী সেলিনা ইসলাম সিআইপিকেও এমপি বানানোর স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠেন তিনি। কোটি কোটি টাকা খরচ করে ছয় জন এমপির সমর্থন আদায়ের মধ্য দিয়ে স্ত্রীকেও তিনি সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি বানাতে সক্ষম হন।

এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে কুয়েতের আরবি দৈনিক আল কাবাস ও আরব টাইমস বাংলাদেশের এক এমপিসহ তিন মানব পাচারকারীর বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

কুয়েতের গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে ওই প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছিল, স্বতন্ত্র এই এমপিসহ তিনজনের চক্র অন্তত ২০ হাজার বাংলাদেশিকে কুয়েতে পাঠিয়ে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা আয় করেছে। কুয়েতের সংসদে তাকে ঘিরে ব্যাপক আলোচনা চলছে। সকল অভিযোগ প্রমাণ
হলে কুয়েতে তার জেল হবে।

এরইমধ্যে এমপি পাপুল ও তার কোম্পানির ১৩৮ কোটি টাকা জব্দ করেছে কুয়েত সরকার। অপরাধ প্রমাণিত হলে তার এ টাকা বাজেয়াপ্ত হবে।

এমপি দুর্জয়কে ঘিরে সর্বত্র তোলপাড়:
মানিকগঞ্জ-১ আসনের এমপি নাঈমুর রহমান দুর্জয়কে ঘিরে জেলার সর্বত্র তোলপাড় শুরু হয়েছে। গত কয়েকদিন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দুর্জয় ও তার ঘনিষ্ঠজনদের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, বখরাবাজি নিয়ে প্রকাশিত খবরা খবরই এখন আলোচনা সমালোচনার শীর্ষে। রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, চায়ের দোকান সবখানেই একই আলোচনা।

ওয়েস্টিন হোটেলে পাপিয়াকাণ্ড নিয়েও তার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনা আছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের সূত্র ধরেই দুর্জয় এমপি ও তার সহযোগিদের নানারকম দুর্নীতি লুটপাটের এন্তার তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। তার অন্যতম দুর্নীতির একটি হচ্ছে, আরিচা ঘাটের কাছে নদী ভাঙন ঠেকানোর নামে সরকারি টাকায় বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজার দিয়ে যমুনা নদী থেকে বালু উত্তোলন এবং তা নিহালপুর এলাকায় পরিত্যক্ত খন্দকার ইটের ভাটায় মজুত করে বিক্রি করা। এটি সম্পূর্ণ অবৈধ।

বিআইডব্লিউটিএ সাধারণ নাব্যতা সংকটের কারণে ড্রেজিং করে থাকে। কিন্তু সেখানে এবার কোনো নাব্যতা সংকট না থাকলেও শুধু এমপির বালুর ব্যবসার জন্য ড্রেজিং করা হয়। যে কারণে এবার বর্ষা আসার আগেই আরিচায় নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে।

এছাড়া আরিচায় বিআইডব্লিউটিএর বিশাল টার্মিনাল দখল করে দীর্ঘদিন ধরে বালুর ব্যবসা চলছে এমপি দুর্জয়ের নামেই। আরিচা-কাজিরহাট নৌ-রুটে অবৈধভাবে স্পিডবোটের ব্যবসাটিও তার দখলেই। এই লকডাউনের মধ্যে আরিচা ট্রলার ঘাটের নিয়ন্ত্রণ নেয় তার এলাকার ছাত্রলীগ। তারা মাঝিদের ঘাট থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজেরা অধিক ভাড়ায় যাত্রী পারাপার শুরু করে। এমপির চাচা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তায়েবুর রহমান টিপুর অত্যাচারে শিবালয় এলাকায় কেউ জমি কিনতে পারছে না। কোনো শিল্পপতি জমি কিনতে গেলেই তিনি চাঁদা দাবি করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এমপি দুর্জয়ের কারণেই শিবালয়ের আলোকদিয়ার চরে সোলার বিদ্যুৎ প্লান্টের কাজ থমকে গেছে। কারণ ওই প্লান্টের মাটি ভরাটের কাজে বাজার দরের চেয়ে অনেক বেশি টাকা দাবি করা হয়। ফলে কোম্পানি আর এগোয়নি।

অভিযোগ আছে, মানিকগঞ্জের শিবালয়, ঘিওর ও দৌলতপুর উপজেলার সব ধরনের ঠিকাদারি কাজ চলে দুর্জয়ের ইঙ্গিতে। তার নিয়ন্ত্রিত দল-উপদলের নেতাদের খুশি না করে সেখানে কোনোরকম কর্মকাণ্ড চালানোর দুঃসাহস রাখেন না ঠিকাদাররা। হাটবাজার ইজারা নেওয়া, খেয়াঘাট বরাদ্দ পাওয়া, খাসজমি ইজারা পাওয়া থেকে শুরু করে ব্রিক ফিল্ডে মাটি সাপ্লাই দেওয়ার ক্ষেত্রেও নির্ধারিত চাঁদা পরিশোধ করে তবেই পা ফেলা যায়। এমপি দুর্জয়ের নামে মাটি খননের নিষিদ্ধ এসকেবিউটর ভেকু মেশিন চলে শতাধিক। হাজার হাজার একর পলি জমি মুহূর্তেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ড্রেজিং চলছে অবিরাম। কাজীরহাট রুটে চরম ঝুঁকি নিয়ে চলছে স্পিডবোট। এমপির নির্দেশনা পুঁজি করেই এসব চলছে।

দুর্জয়ের অপর্কম এবং ঘুষ বাণিজ্যের খতিয়ান:
শিবালয়, ঘিওর ও দৌলতপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত মানিকগঞ্জ-১ সংসদীয় আসনে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতাদের পেছনে ফেলে নৌকা প্রতীক পান সাবেক ক্রিকেটার দুর্জয়। বিপুল ভোটে এমপি নির্বাচিত হন তিনি। কিন্তু নির্বাচনের পর এলাকার গরিব মানুষের কাছ থেকে চাকরি দেওয়ার নামে টাকা আদায়সহ নানা খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ফলে খ্যাতিমান এ ক্রিকেটারের জনপ্রিয়তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা।

নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের নির্বাচনী এলাকার অসংখ্য বেকার যুবক বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরির আশায় সর্বস্ব খুইয়েছেন। তারা এমপি দুর্জয়ের পেছনে যেমন মাসের পর মাস ধর্ণা দিয়েছেন, চাকর বাকরের মতো ফুট ফরমায়েশ খেটেছেন, পাশাপাশি চাকরি নিশ্চিত করতে এমপির ঘনিষ্ঠদের হাতে তুলে দিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের কারো ভাগ্যেই চাকরি জোটেনি, ফেরত পাননি টাকাও। ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষজন চড়া সুদে আনা টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়ে প্রতি মাসে সুদ গুনতে বাধ্য হচ্ছেন। এমপির বাসভবনে চাকরির প্রলোভন দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রতারণামূলক কাণ্ড থেকে দলীয় নেতা কর্মীরা পর্যন্ত রেহাই পাননি।

মানিকগঞ্জের দৌলতপুরের চরকাটারী ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক। দলীয় পদবি ব্যবহার করে কোথাও প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেননি তিনি। টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজির সঙ্গেও জড়িত নন।

অভাবী পরিবারের সন্তান আবু বকর সিদ্দিক স্বপ্ন দেখেন ছোট একটি চাকরির। কিন্তু চাকরি তো হয়ইনি, উল্টো স্থানীয় সংসদ সদস্য দুর্জয়ের নামে তারই ভাগ্নে আব্বাস ঘুষ বাবদ হাতিয়ে নিয়েছেন ৫ লাখ টাকা। টাকা এখনও ফেরত পাননি তিনি। আড়াই বছর ধরে সুদের ঘানি টানছে তার পরিবার।

তিনি বলেন, টাকা ফেরত না পেয়ে আমি এমপি সাহেবের (দুর্জয়) সঙ্গে ঢাকায় তার লালমাটিয়ার বাসায় দেখা করি। তিনি আমাকে আরও কিছুদিন ধৈর্য ধরতে বলেন। আবার সার্কুলার দিলে চাকরির নিশ্চয়তা দেন। কিন্তু সে চাকরি জোটেনি আজও।

একই উপজেলার লাউতারা গ্রামের মৃত মহির উদ্দিনের এতিম ছেলে আবদুল আজিজও এমপি চক্রের নির্মম চাকরি বাণিজ্যের শিকার হয়েছেন। স্কুলে পিয়নের চাকরি নিতে তাকেও খোয়াতে হয়েছে ১৪ শতাংশ জমির ওপর গড়ে তোলা একটি বাগান এবং এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের পুরোটাই।

এ প্রসঙ্গে আজিজ বলেন, পিয়ন পদের জন্য ঘুষ বাবদ ৬ লাখ টাকা এমপির ঘনিষ্ঠ আব্বাসের কাছে পৌঁছে দেই। কিন্তু চাকরি হয়নি, টাকাও ফেরত পাইনি। এখন ঋণ শোধ করার জন্য প্রতি সপ্তাহেই হাজার টাকা কিস্তি দিতে হচ্ছে।

এসব ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা হলে মানিকগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য নাঈমুর রহমান দুর্জয় বরাবরই সাংবাদিকদের বলেন, ‘অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। চাকরিপ্রার্থীরা যাকে ঘুষ দিয়েছেন তাদেরকে জিজ্ঞাসা করুন।’

তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।’

বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না এমপি এনামুলের:
রাজশাহী-৪ আসনের (বাগমারা) এমপি এনামুল হকের গোপনে দ্বিতীয় বিয়ে এবং হঠাৎ ছাড়াছাড়ি নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়। এরপর এ নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় হয়। ফেসবুক ও পত্রিকায় তাদের অনেক অন্তরঙ্গ ছবিও প্রকাশ হয়। ব্যাপারটি মামলা পর্যন্ত গড়িয়েছে। ফেসবুকে একের পর এক পোস্ট এবং কোটি টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ তুলে আয়েশা আক্তার লিজা নামের ওই নারীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এমপি এনামুলের ব্যক্তিগত সহকারী বাগমারা উপজেলা পরিষদের ভাইস-চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান আসাদ তথ্যপ্রযুক্তি আইনে এ মামলা দায়ের করেন। মামলায় লিজাকে এমপি এনামুল হকের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

বাগমারা থানার ওসি আতাউর রহমান জানান, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টার পর মামলাটি (থানার মামলা নম্বর ৬, তারিখ-৫ জুন, ২০২০) দায়ের করার পরই পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। অপরদিকে আয়েশা আক্তার লিজা নিজেকে এখনো এমপি এনামুলের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে দাবি করছেন। লিজা বলছেন, তিনি কোনো কাগজ পাননি।

বিরোধের কারণ হিসেবে লিজা বলেন, আমি প্রকাশ্যে স্ত্রীর মর্যাদা দাবি করায় এমপি সাহেব বিষয়টা অস্বীকার করেছেন। ফলে আমি পরিস্থিতির শিকার হয়ে ফেসবুকে আমাদের অন্তরঙ্গ ছবিসহ বেশকিছু প্রমাণ প্রকাশ করেছি। কারণ আমি এমপি সাহেবের রক্ষিতা নই, বিয়ে করা বৈধ স্ত্রী।

লিজার পক্ষ থেকে জানানো হয়, ২০১৩ সালে তাদের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং ২০১৮ সালের ১১ মে তাদের বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়। এরপর পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয়।

এমপি এনামুল হক বিয়ের বিষয়টি স্বীকার করে সাংবাদিকদের জানান, তিনি দেনমোহরের দশ লাখ টাকাও পরিশোধ করেছেন।

তিনি দাবি করেন, বিয়ের পর তিনি লিজার চাঁদাবাজি ও ব্ল্যাকমেইলের শিকার হন। অবশেষে বাধ্য হয়ে তাকে তালাক দেন।

অন্যদিকে প্রতারণার মাধ্যমে জীবন নষ্ট করা, স্ত্রীর স্বীকৃতি পাওয়া ও গর্ভের বাচ্চা নষ্ট করার বিচার চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আরজি জানানোর কথা বলেছেন লিজা। তিনি বলেন এমপি সাহেব মামলা হয়রানির পাশাপাশি তার লোকজন দিয়ে আমাকে হুমকি দিচ্ছে। জীবন নিয়ে সংশয়ে আছেন বলেও দাবি করেন লিজা।

বিতর্কের শেষ নেই:
গোপনে দ্বিতীয় বিয়ে করা আর তাকে ডিভোর্স দেওয়া না দেওয়া বিতর্কের মধ্যেই এনামুল হক এমপির আলোচনা শেষ নয়। তিনি তিন দফা এমপি নির্বাচিত হলেও প্রতিবারই নিয়োগ বাণিজ্য, বিএনপি-জামায়াতিদের পূণর্বাসন ও জঙ্গিদের দলে ঠাঁই দেওয়া নিয়েও একের পর এক বিতর্কে জড়িয়েছেন।

রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৫০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘দফতরি কাম প্রহরী’ পদে ৫০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। দুই ধাপে এ নিয়োগ হয়। নিয়োগের জন্য তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু প্রার্থী নির্বাচনে কমিটির কোনো ভূমিকা ছিল না।

বাগমারা-৪ আসনের এমপি এনামুল হক নিয়োগের আগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে একটি ডিমান্ড অর্ডার (ডিও) লেটার পাঠাতেন। কোন প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে হবে চিঠিতে তার উল্লেখ থাকত। সে তালিকা ধরেই প্রার্থী নিয়োগ দিতে বাধ্য হয়েছে কমিটি। অভিযোগ আছে, নিয়োগ দেওয়ার বিনিময়ে প্রত্যেক প্রার্থীর কাছ থেকে এনামুল হক চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা করে নিয়েছেন। সে হিসাবে অন্তত দুই কোটি টাকা নিয়েছেন তিনি। নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিরা টাকা দেওয়ার কথা স্বীকারও করেছেন। সংশিষ্ট ইউএনও ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাও স্বীকার করেছেন যে কেবল এমপির মনোনীত প্রার্থীদেরই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

বাগমারার ইউএনওর দফতর ও প্রাথমিক শিক্ষা দফতর সূত্রমতে, উপজেলায় ২০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় দফতরি কাম প্রহরী পদে লোক নিয়োগে এনামুল হক পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দিতে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে একটি ডিও লেটার দেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আপনার শুভ দৃষ্টি আকর্ষণপূর্বক জানাচ্ছি যে, আমার নির্বাচনী এলাকা ৫৫, রাজশাহী-৪, বাগমারা উপজেলার অন্তর্গত নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধীনে দফতরি কাম প্রহরী পদে নিয়োগ দানের জন্য সুপারিশ করা হলো। আমার বিশ্বাস, তাদের উক্ত পদে নিয়োগদান করলে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবে।’ ২০টি পদের বিপরীতে আবেদন করেছিলেন অন্তত ৮০ জন প্রার্থী। কিন্তু নিয়োগ কমিটি এমপির মনোনীত ২০ জন প্রার্থীকেই নিয়োগ
দেয়।

তবে এসব নিয়োগে বাণিজ্যের কথা অস্বীকার করেছেন এমপি এনামুল হক। তিনি বলেন, ওই সময় দলীয় কিছু লোকের জন্য ডিও লেটার দেওয়া হয়েছে। তবে কারও কাছ থেকে অর্থ নেওয়া হয়নি।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, টাকা ছাড়া চাকরি হয়েছে এমন নজির কমই আছে। বেশির ভাগ নিয়োগ পেয়েছে জামায়াত-বিএনপির লোকজন। শুধু চাকরি নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি পদে বিএনপি-জামায়াতের লোকদেরই বসানো হয়েছে।

যোগীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল জানান, এনামুল হকের সাড়ে ১০ বছরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার মাধ্যমে কারা নিয়োগ পেয়েছেন খোঁজ নিলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।

Pin It