চীনের নতুন চান্দ্রবর্ষ উদযাপনের জন্য ১৮ জানুয়ারি পাঁচ আত্মীয়কে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান সালিয়া ইয়াং নামের এক তরুণীর মা। এর তিন দিন পর সালিয়ার মা জ্বরজ্বর অনুভব করেন। এরপর দ্রুত তার পুরো পরিবারই অসুস্থ হয়ে পড়ে। সালিয়ার মাকে হাসপাতালে ভর্তির চেষ্টা করা হলেও কোনো বেড খালি পাওয়া যাচ্ছিল না। অবশেষে জানা যায়- সালিয়ার মায়ের পাশাপাশি তার দাদা-দাদিও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত।
সালিয়ার গুরুতর অসুস্থ মাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও বেডের অভাবে তার দাদা-দাদিকে বাড়িতে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হয়। হাসপাতালে ভর্তির চার দিন পর মারা যান সালিয়ার মা। এর দু’দিন পর মারা যান তার দাদা। পরে প্রাণঘাতী করোনায় আক্রান্ত হন সালিয়ার ছোট ভাইও। করোনার কারণে এভাবে তছনছ হয়ে যায় চীনের উহানে বসবাসরত সালিয়ার পরিবার। ওয়াশিংটনে কর্মরত সালিয়া এখনও সুস্থ আছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী শহরেও দ্রুত ছড়াচ্ছে করোনা।
ইতালির নেপলস শহরের এক অভিনেতার বোন থেরেসা ফ্রান্জাসে মারা যাওয়ার পর ৩৬ ঘণ্টায়ও তার সৎকার হয়নি। বাড়িতে রাখা মরদেহটি থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। মরদেহ নিয়ে যাওয়ার জন্য ইতালি কর্তৃপক্ষকে রাজি করাতে ওই নারীর ভাইকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আকুল আবেদন জানাতে হয়েছে। ওই নারী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন সন্দেহে স্থানীয় কোনো হাসপাতালও তার লাশ নিতে অস্বীকৃতি জানায়। শেষ পর্যন্ত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় জড়িত একটি সংস্থার কর্মীরা মাস্ক, সুরক্ষিত জুতা, স্যুট, গল্গাভসসহ অন্যান্য জিনিস পরে মরদেহ স্থানীয় সমাধিস্থলে নিয়ে গিয়ে সরাসরি কবর দেন।
ইরানের কোম শহরের বেহেশতি মাসুমেহ হাসপাতালের মর্গের ফ্লোরে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য মরদেহ। হাসপাতাল কর্মীরা এর পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। লাশের দিকে তাকানোর সময়ও তাদের নেই। অথচ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে কোনো মুসলিম মারা গেলে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী তাকে অতি দ্রুত সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে দাফন করা হয়। সেই রীতি এখন পরিত্যক্ত। ব্রিটেনে এক বাংলাদেশির মৃত্যুর পর তার মরদেহও দেখতে পারেননি সন্তানসহ পরিবারের সদস্যরা। কারণ, তাদের প্রত্যেককেই কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।
বৈশ্বিক মহামারিতে পরিণত হওয়া করোনাভাইরাসের কারণে দেশে দেশে এভাবেই মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। এর বিপরীত চিত্রও অবশ্য আছে। মানবিক বিপর্যয় রোধে মানুষই তো এগিয়ে আসে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। করোনার উৎপত্তিস্থল চীনেও শোনা গেছে মানবিকতার জয়গান। প্রবলভাবে ছোঁয়াচে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের সেবায় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সত্যিকার অর্থেই জীবন বাজি রেখে কাজ করে চলেছেন। বিপন্ন মানবতার সেবা করতে গিয়ে চীনের ৩ হাজার ৪০০ স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন চিকিৎসকসহ অন্তত ১৩ জন। এমন ঘটনা দেখা গেছে অন্য দেশগুলোতেও। ইরানে চিকিৎসাসামগ্রী প্রস্তুতকারক একটি প্রতিষ্ঠান বাড়তি চাহিদার জোগান দেওয়ার জন্য ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা হচ্ছে।
করোনার সংক্রমণ রোধে বিশ্বের বহু দেশ তার স্থল ও আকাশপথ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে নিজ দেশে কোনো নিকটজনের মৃত্যু হলে শেষবারের মতো দেখতে পারছেন না প্রবাসে থাকা স্বজন। কিংবা প্রিয়জনের সান্নিধ্য পেতে আরও অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বহু মানুষকে। সারা দুনিয়ার বহু অঞ্চলের শিল্পোৎপাদন ও যান চলাচল বন্ধ থাকায় দিনমজুর কিংবা শ্রমজীবী মানুষের ওপর তার নিদারুণ প্রভাবও সহজেই অনুমেয়।
এদিকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আরও ছড়িয়ে পড়ছে। গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বিশ্বের ১২০টির বেশি দেশের এক লাখ ৪০ হাজার ৩২ জন। মারা গেছেন ৫ হাজার ৩৩৮ জন। এর মধ্যে ইতালিতে গতকাল শুক্রবার (২৪ ঘণ্টায়) একদিনেই মারা গেছে ২৫০ জন। গত ডিসেম্বরে চীনে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর একদিনে এটিই সর্বোচ্চ মৃত্যু। এ নিয়ে ইতালিতে মৃতের সংখ্যা পৌঁছল এক হাজার ২৬৬ জনে। আক্রান্তের সংখ্যা দুই হাজার ৫৪৭ বেড়ে পৌঁছেছ ১৭ হাজার ৬৬০ জনে। ইরানেও এদিন মারা গেছেন আরও ৮৫ জন। ফলে দেশটিতে মৃতের সংখ্যা ৫১৪ জনে পৌঁছেছে। দেশটিতে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ২৮৯ জন। গতকাল পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছেছে ১১ হাজার ৩৬৪ জনে।
চীনের পর দক্ষিণ কোরিয়া, তারপর ইরান ও ইতালিতে করোনা রুদ্ররূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়। এবার করোনার ভয়াল থাবা পড়েছে স্পেনেও। দেশটিতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছেই। গতকাল স্পেনে আরও ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ দিন পর্যন্ত মোট মারা গেছেন ১২০ জন। আক্রান্তের সংখ্যা ১২০০ বেড়ে পৌঁছেছে ৪২০৯ জনে। স্পেনে আগামী সপ্তাহের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে কর্তৃপক্ষ সতর্ক করে দিয়েছে। পরিস্থিতি সামলাতে গতকাল স্পেনে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গতকাল বলেছে, করোনার নতুন উৎসস্থলে পরিণত হয়েছে ইউরোপ।
আশার কথা হচ্ছে, সারা বিশ্বে আক্রান্তের মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ ইতোমধ্যে সেরেও উঠেছেন। আক্রান্ত ও মৃত্যুর অধিকাংশ ঘটনা চীনে ঘটলেও গত কয়েক দিনে তা অনেক কমেছে। করোনার উৎস হুবেই প্রদেশে নতুন রোগীর সংখ্যা বৃহস্পতিবার নেমে এসেছে ৬ জনে। চীনের মূল ভূখে এদিন নতুন করে ৩৩ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে, মারা গেছেন সাতজন।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর স্ত্রী সফি। ট্রুডোকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাতের পর ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেয়ার বলসোনা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য পরীক্ষায় তার করোনা শনাক্ত হয়নি। ট্রাম্পেরও করোনাভাইরাস পরীক্ষার দাবি উঠেছে। অবশ্য হোয়াইট হাউস এ দাবি নাকচ করে দিয়েছে। ট্রাম্পকন্যা ইভাঙ্কার সঙ্গে সাক্ষাতের পর করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পেটার ডাটন। করোনা রোধে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টে আরোহণ স্থগিত করেছে নেপাল। চীন আরও আগেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব ঘটনায় এটাই প্রমাণিত হচ্ছে যে, এই মহামারি এখন আর কোনো সীমা মানছে না। করোনা নিয়ন্ত্রণে যারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবেন, রাষ্ট্রের সেই নীতিনির্ধারকদেরও অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়। এমনকি মৃত্যুও হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও রাজ্যের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু এই রাজ্যেই এক লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে তারা আশঙ্কা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬টি রাজ্যের ১ হাজার ৬৬৩ জন আক্রান্ত এবং ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে আজ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হতে পারে।
ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে তিন দিন ধরে কার্যত অবরুদ্ধ দশায় থাকা ইতালিতে বৃহস্পতিবার দেড় হাজার নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। ইউরোপে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠা এ দেশটিতে মৃতের সংখ্যা ইতোমধ্যে এক হাজার ১৬ জনে পৌঁছেছে। আক্রান্ত হয়েছে মোট ১৫ হাজার ১১৩ জন। যুক্তরাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা গতকাল একদিনে ৫৯০ থেকে বেড়ে ৭৯৮-তে পৌঁছেছে। ভারতে গতকাল পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৮১ জন। দিল্লিতে এ দিন আরও একজন মারা গেছেন। ফলে ভারতে এ পর্যন্ত ২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বিভিন্ন দেশ ভ্রমণে কড়াকড়ি আরোপ করতে থাকায় দারুণভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে বিশ্ব যোগাযোগ। একের পর এক আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আয়োজন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা আসছে নানা দেশ থেকে। কোথাও কোথাও খেলা চলছে গ্যালারি শূন্য রেখে। নতুন করে বেলজিয়াম, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি ও ভারতের কিছু অংশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
জীবন-মৃত্যুর সিদ্ধান্ত চিকিৎসকের হাতে :করোনার কারণে এক নজিরবিহীন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। ইতালি ও চীনের বহু লোকের বেঁচে থাকা নির্ভর করছে চিকিৎসকদের সিদ্ধান্তের ওপর।
কারণ, দুটি দেশই বিপুলসংখ্যক রোগীকে নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। হাসপাতালে বেড না থাকায় মুমূর্ষু অনেককে বাড়ি পাঠাতে হয়েছে। তাদের অনেকেই পরে মৃত্যুর কাছে হার মেনেছেন।
এখন যুক্তরাষ্ট্রেও এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালগুলোতে আট লাখ বেড রয়েছে। বয়স্কদের জন্য আইসিইউ রয়েছে ৬৮ হাজার।
যুক্তরাষ্ট্রের সাড়ে ৩২ কোটি মানুষের মধ্যে যদিও ৫ শতাংশও করোনায় আক্রান্ত হয় তবে তাদের অন্তত ২০ ভাগকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। এতে বেড প্রয়োজন হবে ৩২ লাখ। আর আইসিইউ সুবিধা দরকার হবে অন্তত ৬ শতাংশ রোগীর, অর্থাৎ ৯ লাখ ৬০ হাজার মানুষের। যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, দেশটিতে পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ হলে ১৬ কোটি থেকে ২১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। মারা যেতে পারে দুই লাখ থেকে ১৭ লাখ মানুষ। এক বছর ধরে চলতে পারে করোনা তাণ্ডব।
ইরানে লাশ দাফনে সংকট :কোমের বেহেশতি হাসপাতালের মর্গের লাশগুলো রাখা হয়েছে কালো ব্যাগে। করোনায় তাদের মৃত্যু হয়েছে কিনা সেই পরীক্ষাও করা হয়নি। এ পরীক্ষা সময়সাপেক্ষ। তাই লাশের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। পরীক্ষায় কোনো মরদেহের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হলে ব্যবহার করা হয় ক্যালসিয়াম অক্সাইড, যাতে তার কবরের মাটি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত না হয়। তবে যেসব মরদেহে করোনার উপস্থিতি মেলে না সেগুলো দ্রুত পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয় বলে জানিয়েছেন ওই হাসপাতালের পরিচালক আলি রমিজানি।
মানবাধিকার লঙ্ঘন :করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশ্বের বহু দেশ অনেক কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব পদক্ষেপ নেওয়ার সময় কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও ঘটেছে। যেমন চীনে করোনা নিয়ে কথা বলায় গুমের ঘটনাও ঘটেছে। মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধও করা হয়েছে।
ভয়কে জয় করে সুরের ঐকতান :করোনায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ইতালি। দেশটি এখন কার্যত মৃত্যুপুরী। প্রতিদিন মারা যাচ্ছে বহু মানুষ। জীবন বাঁচাতে সরকার পুরো ইতালিকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। দোকানপাট, বার, সেলুন, টুরিস্ট স্পট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সবকিছুই বন্ধ। ফলে সদা প্রাণচঞ্চল ইতালির রাস্তাঘাট এখন খাঁ খাঁ করছে। কেউ কারও সঙ্গে দেখা করতে পারছে না।
এ অবস্থায় ইতালির সিয়েনার বাসিন্দারা নিয়েছেন এক অভিনব উদ্যোগ। নিজেদের মধ্যে সংহতি বাড়াতে তারা গেয়েছেন স্থানীয় একটি জনপ্রিয় গান। ঘোষণা অনুযায়ী প্রত্যেকে নিজ বাড়ির জানালার কাছে এসে গলা ছেড়ে গেয়েছেন ‘কান্তো দেলা ভারবেনা (ইতালি যখন ঘুমায়)’ গানটি। এটাকে মানবতার পক্ষে ‘সুন্দর কাজ’ বলে মন্তব্য করেছেন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা। ওই দৃশ্য ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইনে। কেউ কেউ এই দৃশ্য দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।