কর্ণফুলী নদী বাঁচাতে প্রথমবারের মতো চূড়ান্ত করা হয়েছে মহাপরিকল্পনা। ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’, ‘স্বল্পমেয়াদি’, ‘মধ্যমেয়াদি’ এবং ‘দীর্ঘমেয়াদি’ অ্যাকশন রেখে সাজানো হয়েছে ১০ বছরের এ মহাপরিকল্পনা। এতে ৪৫টি মূল কার্যক্রম এবং ১৬৭টি সহযোগী কার্যক্রম চিহ্নিত করা হয়েছে। নগরের বর্জ্য এবং কলকারখানার দূষিত পানি যাতে নদীতে মিশতে না পারে, সে বিষয়েও আছে নির্দেশনা। অবৈধ দখলে থাকা ভূমি কীভাবে উদ্ধার করা হবে, উদ্ধারকৃত ভূমি কীভাবে সংরক্ষণ করা হবে, এটিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে পর্যটন সুবিধা বাড়ানো যাবে, নগরের বর্জ্য কোথায় কীভাবে বিকল্প স্থানে সংরক্ষণ করা হবে এসব- বিষয়েরও দিকনির্দেশনা আছে এ মহাপরিকল্পনায়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে তৈরি হওয়া এ মহাপরিকল্পনা এরই মধ্যে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। উচ্চ আদালতের নির্দেশে শুরু হওয়া উচ্ছেদ অভিযান মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেলেও শিগগির মহাপরিকল্পনা ধরে শুরু হবে অভিযান।
বিষয়টি স্বীকার করে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘মহাপরিকল্পনা তৈরি করতে চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যানকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এ কমিটি খসড়া মহাপরিকল্পনা জমা দিয়েছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে। সেখানে এটির চূড়ান্ত অনুমোদন মিলেছে। এখন এ মহাপরিকল্পনা ধরে পুরনো রূপে ফিরিয়ে আনা হবে কর্ণফুলী নদীকে। আগে আদালতের নির্দেশে আমরা উচ্ছেদ অভিযানের নেতৃত্ব দিলেও এখন বন্দরের পরিকল্পনায় সহযোগী হিসেবে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে জেলা প্রশাসন।’
একই প্রসঙ্গে বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল জুলফিকার আজিজ বলেন, ‘কর্ণফুলী নদীর মোহনায় অবস্থিত চট্টগ্রাম বন্দর। এ নদীর আশপাশে টার্মিনালসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থাপনাও আছে আমাদের। তাই কর্ণফুলীর জন্য তৈরি হওয়া মহাপরিকল্পনায় নেতৃত্ব দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। চূড়ান্ত হওয়া মহাপরিকল্পনা ধরে শিগগির শুরু হবে আমাদের অ্যাকশন।’ ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’, ‘স্বল্পমেয়াদি’, ‘মধ্যমেয়াদি’ এবং ‘দীর্ঘমেয়াদি’ অ্যাকশন রেখে ১০ বছরের এ মহাপরিকল্পনা সাজানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ এ নদীর গতিপথ স্বাভাবিক রাখতে ২০১০ সালের জুলাই মাসে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠনের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে কর্ণফুলী নদী দখল, মাটি ভরাট ও নদীতে যে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণের কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে নদীর প্রকৃত সীমানা নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককেও নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। জরিপ করে নদীর দুই তীরে দুই হাজার ১৮১ অবৈধ স্থাপনা আছে বলে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন। জরিপ প্রতিবেদনটি ২০১৫ সালের ৯ জুন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার ও অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে হাইকোর্টে দাখিল করে জেলা প্রশাসন। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট বিচারপতি মো. রেজাউল হাসান ও বিচারপতি কাশেফা হোসেনের ডিভিশন বেঞ্চ সব স্থাপনা উচ্ছেদে তিন মাসের সময়সীমা বেঁধে দেন। কিন্তু তিন মাসের স্থলে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছিল তিন বছর পর; চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। মাত্র ১০ একর ভূমি উদ্ধার করেই উচ্ছেদ অভিযানে ইতি টেনেছে অভিযানে থাকা চার সংস্থা। এখন কর্ণফুলী রক্ষায় নতুন করে চূড়ান্ত করা হলো এ মহাপরিকল্পনা। এটির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
আদালতের নির্দেশে আগে শুধু উচ্ছেদ অভিযানের কথা থাকলেও এবারের মহাপরিকল্পনায় আছে কর্ণফুলী নদীর নাব্য বৃদ্ধি ও দূষণমুক্ত করতে কী কী কাজ করতে হবে সেটির সার্বিক দিকনির্দেশনা। কোন প্রক্রিয়ায় উদ্ধার করা ভূমিকে পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলা যাবে, সেটিও উল্লেখ করা হয়েছে এতে। স্যুয়ারেজ সিস্টেম ও ওয়েস্টেজ ম্যানেজমেন্ট নিয়েও আছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা।
মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করার পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আয়োজিত ব্রিফিংয়ে মন্ত্রী তাজুল ইসলাম জানান, আরবান এলাকায় যেসব বর্জ্য আছে সেগুলো শতভাগ যেন ডিসপোজ করতে পারে সে ব্যাপারেও দিকনির্দেশনা আছে মহাপরিকল্পনায়। ১০ বছরের কার্যক্রম যথাযথভাবে করা গেলে নদী শুধু দখলমুক্ত হবে না, হবে দূষণমুক্তও।’ তিনি জানান, দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলো পুনরুদ্ধার করতে সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। এরই ধারাবাহিকতায় কর্ণফুলী ও বুড়িগঙ্গা নিয়ে মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে।
জানা গেছে, এক বছর, তিন বছর, পাঁচ বছর ও ১০ বছরের পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে মহাপরিকল্পনাকে। কোন সংস্থা কীভাবে এ মহাযজ্ঞে অংশ নেবে ও সহায়তা করবে, সেটির জন্যও আছে নির্দেশনা। ভূমি উদ্ধারের পর নদীতীরে গাছ লাগানো হবে। গড়ে তোলা হবে বিনোদন স্পট। উদ্ধার হওয়া ভূমি যাতে পুনরায় কেউ বেদখল করতে না পারে, সেজন্য থাকবে বিশেষ মনিটরিং টিম। এ টিমের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে যে কোনো সময় চালানো যাবে উচ্ছেদ অভিযান।
কর্ণফুলীকে চট্টগ্রামের প্রাণ বলা হলেও সরকারি তালিকায় এখানে অবৈধ দখলদার আছে দুই সহস্রাধিক। আবার চট্টগ্রাম মহানগর এলাকার ৮৪টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে অধিকাংশের বর্জ্য শোধনাগার প্লান্ট (ইটিপি) নেই। এসব শিল্পকারখানার বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে মিশে পানি মারাত্মকভাবে দূষিত করে তুলেছে। কর্ণফুলী নদী দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী স্যুয়ারেজ বর্জ্য। চট্টগ্রাম মহানগরীর ৬০ লাখ মানুষের স্যুয়ারেজ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বর্জ্য ট্রিটমেন্ট প্লান্ট না থাকা কর্ণফুলী নদীর পানিদূষণের প্রধান কারণ। চট্টগ্রাম ওয়াসাকে দিয়ে তাই স্যুয়ারেজের একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় পুরো নগরীকে ছয়টি ব্লকে বিভক্ত করে বিশ লাখ মানুষকে স্যুয়ারেজের আওতায় নিয়ে আসার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা স্থাপন প্রকল্প (প্রথম পর্যায়)’ নামের এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৮০৮ কোটি ৫৮ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। চূড়ান্ত অনুমোদনের পর এখন পরামর্শক নিয়োগের অপেক্ষায় আছে এ প্রকল্প।
এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর গত ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত কর্ণফুলী থেকে সংগ্রহ করা পানির নমুনা পরীক্ষা করে নদীর ডিজলভড অক্সিজেনের (ডিও) মান ৪ দশমিক ৮ থেকে ৫ দশমিক ৫ এর মধ্যে পায়। এটি উদ্বেগজনক। কারণ ডিওর মান ৪-এর নিচে নামলে তা পানিতে বিদ্যমান জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। অথচ কর্ণফুলী নদীতে পতিত খালগুলোর পানি পরীক্ষা করে দেখা গেছে খালের পানিতে ডিওর মান প্রায় শূন্য পর্যায়ে। দূষণ ও দখলমুক্ত করতে চূড়ান্ত হওয়া মহাপরিকল্পনা তাই কর্ণফুলী নদী বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন নগরবাসী।