ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রেখে আগামীতে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে চলার কথা বলেছেন ডাকসুর নবনির্বাচিত জিএস ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। গতকাল বুধবার রাজধানীর একটি রেস্টুরেন্টে সমকালের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তরুণ এই ছাত্রনেতা বলেন, সবাইকে নিয়ে চলতে চাই। এই মানসিকতা ধারণ করি। কাজ দিয়েই শিক্ষার্থীদের মন জয় করব। কে প্রতিপক্ষ আর কে কোন রাজনীতি করেন, তা না দেখে শিক্ষার্থীবান্ধব কাজেই ফোকাস থাকব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ রাখার জন্য সম্ভাব্য সব কিছু করতে চাই।
দীর্ঘ ২৮ বছর পর ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্রসমাজের দাবি-দাওয়া পূরণের ন্যায্য প্ল্যাটফর্মের শূন্যতা পূরণ হতে যাচ্ছে। ফলে ডাকসুর নতুন নেতৃত্বের ওপর রয়েছে শিক্ষার্থীদের বিপুল আশাবাদ। এ প্রসঙ্গে জিএস গোলাম রাব্বানী বলেন, ডাকসু একটি অনুভূতির নাম। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হলেও এখন ডাকসুর মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়াতে সত্যিকার অর্থে নিজেকে সব শিক্ষার্থীর নেতা বলা যাবে। কণ্ঠ অনেক উচ্চকিত হবে; আত্মবিশ্বাস হবে অনেক বেশি।
তিনি আরও বলেন, পর্যায়ক্রমে প্রতিটি সমস্যা নিয়ে কাজ করতে চাই। প্রত্যাশার চাপ অনেক বেড়েছে, এটা সত্য। তবে দেশরত্ন শেখ হাসিনার কর্মী হিসেবে চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসি। তিনি যেভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে জননেত্রী থেকে বিশ্বনেত্রীতে পরিণত হয়েছেন, সবার আস্থা অর্জন করেছেন, তারই কর্মী হিসেবে আমিও শিক্ষার্থীদের অধিকারের জন্য সেভাবে কাজ করতে চাই। সব প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করার মানসিক দৃঢ়তা রয়েছে বলে মনে করি।
ডাকসুর নতুন ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন ছাত্রলীগের বিপরীত একটি প্ল্যাটফর্ম ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের’ নুরুল হক নুর। এ পরিপ্রেক্ষিতে তার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার চ্যালেঞ্জসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা নিয়ে রাব্বানী বলেন, ডাকসুতে যে ২৫ জন নির্বাচিত হয়েছেন তার মধ্যে ২৩ জন সরাসরি ছাত্রলীগ প্যানেলের। এর বাইরে যে দু’জন রয়েছেন তারাও ইতিবাচক মানসিকতার বলে মনে হয়েছে। নতুন ভিপি নুরুল হক নুরও ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। তদের নিয়েই কাজ করতে চাই। এখন তারা একটা ভিন্ন প্ল্যাটফর্মে রয়েছেন, তাতে সমস্যা হবে না।
তিনি আরও বলেন, হল প্রশাসনও আন্তরিক। সবার ওপরে বড় কথা হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে উদার চিত্ত। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব নৈতিক-যৌক্তিক ইস্যুতে ইতিবাচক থাকেন। সব বিল পাস করে দেন। তাছাড়া ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার কারণে ‘আপা’র কাছে যেতে কোনো পাস কিংবা প্রটোকল লাগবে না। সে দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিগুলো অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানাব এবং প্রয়োজনে আপার কাছ থেকে তার অনুমোদন নিয়ে আসতে পারব। অধিকার নিয়ে তার কাছে শিক্ষার্থীদের কথাগুলো বলতে পারব। সবার সহযোগিতা পেলে আশা করি কোনো বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে না।
ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে ছাত্রদলসহ অন্য ছাত্র সংগঠনগুলোর সহাবস্থান একটি নির্দিষ্ট পরিসরে তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যতে আবাসিক হলসহ সর্বত্র সহাবস্থানের এই পরিবেশ বজায় রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, অবশ্যই সহাবস্থান থাকবে। না থাকার কোনো কারণ নেই। আমরা সবাইকে নিয়ে চলতে চাই। কে প্রতিপক্ষ আর কে কোন রাজনীতি করে তা না দেখে আমাদের কাজের প্রতি লক্ষ্য থাকবে। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করেছি। তিনিও বলেছেন মিলেমিশে সবার সঙ্গে কাজ করার জন্য। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ রাখার জন্য সম্ভাব্য সব কিছু করতে চাই। রাব্বানী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন করে পরিবেশ পরিষদ কর্তৃক প্রতিক্রিয়াশীল ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছে। এরমধ্যে ছাত্রসমাজ এবং ইসলামী ছাত্রশিবির রয়েছে। তারা যেন কারও ছত্রছায়ায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট করতে না পারে, শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনে ও তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের প্রতিহত করা হবে। শিক্ষার্থীরাও তাদের প্রতিহত করবে। অতীতে ছাত্রদলের ছত্রছায়ায় শিবির ক্যাম্পাসে এক ধরনের মুভমেন্ট করেছে। এই জায়গাতে ছাত্রদলের প্রতি আহ্বান থাকবে তারা যাতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে বলে যে, তাদের সঙ্গে শিবিরের কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে তাদের স্বাগত জানাব।
নির্বাচনে ভিপি পদে ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনের পরাজয়ের নেপথ্যে দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল দায়ী কি-না এমন প্রশ্নে গোলাম রাব্বানী বলেন, ছাত্রলীগে কোনো অভ্যন্তরীণ কোন্দল নেই। ডাকসু নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের ভোট একান্ত তাদের পছন্দের ব্যাপার। আমার ও সভাপতির ভোটের ব্যবধান অনেকটা কাছাকাছি। সেক্ষেত্রে ছাত্রলীগের বাইরে যারা রয়েছে তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে। দলীয় ভোট যেগুলো রয়েছে সেগুলো সবাই পেয়েছি।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে ঢাবির সবাই ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। সুন্দর পরিবেশ ছিল। শতভাগ সুষ্ঠু-সুন্দর নির্বাচন হয়েছে। এক্ষেত্রে এবং ইতিমধ্যে ছাত্রলীগের সভাপতি অত্যন্ত উদার মনের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ফলাফল মেনে নিয়েছেন এবং ডাকসুর যিনি ভিপি হয়েছেন তাকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাই ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়টি একেবারে সঠিক নয়। যারা বলছে তারা ব্যক্তিগত স্বার্থে ও সুবিধা নেওয়ার জন্য বলতে পারে।
নির্বাচনের আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়ে নতুন জিএস বলেন, মানুষের যে পাঁচটি মৌলিক চাহিদা তার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। সে আলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো পূরণের চেষ্টা করব। শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসনের বিষয়টি প্রথম অগ্রাধিকার থাকবে।
ছাত্রপ্রতিনিধি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে তুলে ধরতে হবে ছাত্রছাত্রীদের আকাঙ্ক্ষার কথা। তিনি বলেন, ডাকসুকে বলা হয় ‘মিনি পার্লামেন্ট’। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে যে শত শত কোটি টাকার বাজেট পাস হয়, সেগুলো শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনে কোথায় খরচ হয়, কতটুকু অপচয় বা অপব্যয় হয়, সেগুলো জানার বা দেখার সুযোগ শিক্ষার্থীদের এতদিন ছিল না। এখন ডাকসুর পক্ষ থেকে যে পাঁচজন প্রতিনিধি সিনেটে যাবেন, তারা শিক্ষার্থীবান্ধব বাজেট প্রণয়নে ভূমিকা রাখবেন।
অতীতে ডাকসুতে যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদের বেশিরভাগই জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্বের আসনে এসেছেন। ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থানের প্রশ্নে গোলাম রাব্বানী বলেন, বিসিএসসহ অন্য অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যাইনি। মানুষের জন্য, দেশের জন্য, দশের জন্য কাজ করতে চেয়েছি। এই আবেগ ও ভালোবাসার জায়গা থেকে জাতীয় রাজনীতিতে নিজেকে দেখতে চাই। ডাকসু হচ্ছে জাতীয় রাজনীতির আঁতুরঘর। এখানে ছাত্রসমাজের জন্য ইতিবাচক ও ভালো কাজের মাধ্যমে নিজের গ্রহণযোগ্য অবস্থান তৈরি করতে চাই। যারা নির্বাচিত হয়েছেন সবাই এমনভাবে কাজ করব যাতে জাতীয় রাজনীতিতে অবদান রাখতে পারি।