কয়েক দিন আগে জাতীয় পার্টির প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যখন তাঁর ভাই গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে পাশে নিয়ে ৯০তম জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান পালন করছিলেন, তখন কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি যে দুদিন পরই তিনি এই ভাইকে ‘কতল’ করবেন। ‘কতল’ মানে দুই-দুটি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া। ওই অনুষ্ঠানে এরশাদ বলেছিলেন, ‘এটাই সম্ভবত আমার শেষ ভাষণ।’ সেটি সংসদে বিরোধী দলীয় উপনেতা হিসেবে বলেছেন, না জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে, সে কথা স্পষ্ট করেননি।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের মতো জাতীয় পার্টির শিবিরেও আনন্দের হিল্লোল বয়ে যেতে থাকে। আওয়ামী লীগের পর তারাই দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পাওয়ার মতো জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দলের মর্যাদা পেয়ে গেল। আগেরটি ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন। এবার রীতিমতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নাকি তাদের নেতারা জাতীয় সংসদের আসন অলংকৃত করেছেন।
এখন আর এরশাদ সংসদে শুধু জাতীয় পার্টির সদস্যদের নেতা নন, ১৪ দলের সাংসদদেরও নেতা বনে গেছেন। যদিও ১৪ দলের নেতারা তাঁকে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে মানতে ইচ্ছুক নন; কিন্তু সংসদীয় রীতিতে হয় সরকারি দলে, না হয় বিরোধী দলে থাকতে হবে। মাঝামাঝি কোনো পথ নেই। ১৪ দলের নেতাদের যুক্তি হলো, তাঁরা একসঙ্গে আন্দোলন করেছেন, একসঙ্গে নির্বাচন করেছেন, তাহলে একসঙ্গে সরকার পরিচালনা করবেন না কেন? কিন্তু আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এবারের সরকারটি হবে খাঁটি আওয়ামী লীগের। এখানে বাইরের কারও অংশীদারত্ব থাকবে না।
আইন অনুযায়ী জাতীয় সংসদে যখন নেতা থাকেন, তখন একজন বিরোধীদলীয় নেতাও থাকতে হয়। জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এই প্রথমবারের মতো সংসদে বিরোধী দলের নেতা হলেন। এর আগে জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের আসনে বসলেও এরশাদ নেতা ছিলেন না। রওশন এরশাদ নেতা ছিলেন। এরশাদ যখন একাদশ সংসদে বিরোধী দলের নেতা হলেন, তখন প্রশ্ন এল উপনেতা কে হবেন। এরশাদ তাঁর ছোট ভাই গোলাম মোহম্মদ কাদেরকে উপনেতা করলেন। অসুস্থতার জন্য এরশাদ সংসদে উপস্থিত থাকতে পারেন না। উপনেতাই সংসদের কাজ চালান এবং সরকার বা বিরোধী দল কারও পক্ষ থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না। দলের মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা হলেন বিরোধী দলের চিফ হুইপ। জাতীয় পার্টিতে এ রকম একের ভেতরে একাধিক সত্তার বহু নেতা আছেন।
কিন্তু জন্মদিনের অনুষ্ঠানের দুদিন পর এরশাদ প্রথমে যুগ্ম চেয়ারম্যানের পদ থেকে গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে সরিয়ে দেন। এরপর সংসদে বিরোধী দলের উপনেতার পদটিও কেড়ে নিলেন। এখন গোলাম কাদের প্রেসিডিয়াম সদস্য মাত্র। অনেকে বলেন, ২০১৪ সালে গোলাম কাদের ভাইয়ের প্রতি যে অবিচল আস্থা রেখেছিলেন, তারই প্রতিদান দেওয়া হলো দুটি পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে। সেই নির্বাচনে এরশাদের নির্দেশে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। আর অন্যরা তাঁর নির্দেশ অমান্য করে সাংসদ হয়েছিলেন। গত বছর এরশাদ তাঁর ভাইকে যুগ্ম চেয়ারম্যান করলে জাতীয় পার্টি মহলে বেশ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কয়েক দিন পরই রওশন এরশাদকে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম চেয়ারম্যান করা হয়।
জাতীয় পার্টিকে নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানামুখী আলোচনা আছে। অনেক দিন ধরেই দলে দুটি গ্রুপিং ছিল। এরশাদ বনাম রওশন এরশাদ। একসময় রওশন বিএনপিপন্থী ও এরশাদ আওয়ামী লীগপন্থী বলে পরিচিত ছিলেন। দশম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশ নেওয়ার পক্ষে রওশন শক্ত অবস্থান নিলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো হয়। এই নির্বাচনকে ঘিরে এরশাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে আওয়ামী লীগ তাঁর প্রতি নাখোশ হয়। মাঝেমধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে আনা মামলাগুলোও সচল হয়ে ওঠে। একবার এরশাদ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, তিনি দেশের সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত নেতা। বর্তমানে তিনি অসুস্থ। এ অবস্থায় তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে জাতীয় পার্টির দুই গ্রুপের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। সম্প্রতি দলের ও সংসদে রদবদল সেই টানাপোড়েনেরই অংশ।
এখন রওশন এরশাদ সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম চেয়ারম্যান। গোলাম মোহাম্মদ কাদের শুধুই প্রেসিডিয়াম সদস্য। মহাসচিব পদেও রদবদল হতে পারে বলে দলের নেতারা মনে করেন। এর আগে রুহুল আমিন ভূঁইয়া মহাসচিব ছিলেন। নির্বাচনের সময় তাঁর বিরুদ্ধে মনোনয়ন-বাণিজ্যের অভিযোগ এলে তাঁকে সরিয়ে মশিউর রহমান রাঙ্গাকে বসানো হয়েছিল। এখন প্রশ্ন, তিনি কত দিন থাকবেন?
জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রটি এমন যে দলীয় চেয়ারম্যান পুরুষকে নারী ও নারীকে পুরুষ ছাড়া সবই করতে পারেন। তাই দলের এই রদবদলই যে শেষ কথা নয়, সেটি জোর দিয়ে বলা যায়। এরশাদ সাহেব ক্ষমতায় থাকতে তাঁর সিএমএলএ পদবির নতুন নাম ছিল ‘ক্যানসেল মাই লাস্ট অ্যানাউন্সমেন্ট’।
পরবর্তী অ্যানাউন্সমেন্ট, তথা ঘোষণার জন্য দেশবাসীকে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।