আসমানের চাঁদ ডুবে গেলে কৃত্রিম আলোয় যতটুকু দেখা যায় তাতে হুটহাট চোখে পড়ে ক্ষুধার্ত কুকুর, ঝোপঝাড় থেকে মুখ বের করা শিকারী শেয়াল, রাস্তার দুই পাশে প্রেতের মতো দাঁড়িয়ে থাকা দম বন্ধকরা গাছ। নগরপিতার গাড়ী চলে সেসব কুকুর, শেয়াল ও প্রেতকে পেছনে ফেলে – পাগলা ঘোড়ার মতো একরোখা গতি। এই মাত্র তারা একটা গোল চক্করে ঢুকে পড়েছে, যেখান থেকে সাতটা রাস্তা সাত দিকে চলে গেছে। নগরপিতা প্রাণপনে চেষ্টা করছেন কোনো একটা রাস্তা ধরে বের হয়ে যেতে, কিন্তু যে রাস্তা দিয়েই বের হচ্ছে সে রাস্তাই শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিছুদূর যাবার পরেই চোখের সামনে পড়ছে খানাখন্দ বা ডোবা, খাল-বিল বা নদীর মতো কিছু। তারপরও চেষ্টার ত্রুটি করছেন না। ততক্ষণে নগরপিতার পরিবারের সদস্যদের অস্থিরতা শীর্ষ বিন্দুতে, তাদের মনে এই বিশ্বাস দৃঢ় হচ্ছে যে, অচিরেই ভয়ংকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তারপরও শক্তিমান নগরপিতা মনের সবটুকু শক্তি দিয়ে শেষ বারের মতো শেষ রাস্তায় ঢুকে পড়েন। রাস্তাটা বেশ ফাঁকা, প্রশস্ত ও মসৃণ। আবারো গাড়ী চলছে পাগলা ঘোড়ার মতো। কোথাও কোনো খানাখন্দ বা জলাশয় নেই, কুকুর বেড়াল বা শেয়ালের দেখা নেই। তাদের মনে পুনরায় পারিবারিক ভ্রমণের আনন্দ খেলা করে। কিন্তু পরক্ষণেই সেই আনন্দ বিষাদে রূপ নেয়; কারণ, তারা যে রাস্তা দিয়ে ঢুকেছে সেটা একটা জঙ্গলে ঢুকে শেষ হয়ে গেছে। তারা আবারো অস্থির হয়ে ওঠে, আরো বেশি অস্থির হয়ে ওঠে যখন গাড়ীর স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। এই রকম পরিস্থিতিতে নগরপিতা পরিবারের সদস্যদের ভয় না পেয়ে ধৈর্য ধরতে বলেন, তারপর গাড়ী স্টার্ট দেবার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। তবে এক সময় তারা বুঝতে পারে যে এখান থেকে হয়তো ফেরার পথ নেই। তখন তারা ঘর বাড়ি বা লোকালয় খোঁজার চেষ্টা করে। হঠাৎ করে জঙ্গলের ভেতরে এক টুকরো আলো দেখা যায়। তারা চঞ্চল হয়ে ওঠে। মনের মধ্যে আলো জেগে ওঠে, তারা আলোর দিকে যেতে থাকে। কয়েক মিনিট হাঁটার পরে তারা বুঝতে পারে এটা আসলে একটা বাড়ি। সেখানে দিনের মতো আলো ঝলমল করছে। তারা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর কিছুটা দ্বিধা কিছুটা বিস্ময় কিছুটা ভয় নিয়ে খুঁটে খুঁটে দেখার চেষ্টা করে। বাড়িতে মোট সাতটা ঘর, একটা থেকে আরেকটা বিচ্ছিন্ন। কোনোটা ছোটো কোনোটা বড়ো, কোনোটা স্বর্ণের তৈরী, কোনোটা তামার তৈরী, কোনোটা মাটির তৈরী, বরফের তৈরী ঘরও দেখা যায়। এই সব ঘরের চারপাশে মোট পাঁচটা দিঘি। দিঘিগুলো এতো বড়ো যে সাতটা ঘরের তুলনায় দিঘিগুলোর আয়তন তিন গুণের মতো হতে পারে। আবার এক দিঘি থেকে অন্য দিঘিতে যাবার জন্য ছোটো ছোটো নালা বা খাল আছে। নগরপিতা ও তার পরিবারের সদস্যরা কাছে যায়। তারা অবাক হয়ে যায়, কেমন নেশা ধরে যায়। ভয়, সংশয় ও ঘোরের মধ্যে তারা আগায়। হাঁটতে হাঁটতে পশ্চিম পাশের স্বর্ণের ঘরে প্রবেশ করে। হঠাৎ মানুষের আওয়াজ পাওয়া যায়। একটা লোক পালংকের উপরে শুয়ে আছে। সাদা চামড়া, খাড়া নাক, সোনালি চুল ও দীর্ঘ দেহ। তার বয়স বোঝা যায় না, চোখ বুঁজে আছে। আরেকটু কাছে গেলে বোঝা যায় লোকটার চোখের দুই পাতা এক সাথে মিশিয়ে শেলাই করা। লোকটা কথা বলতে থাকে :
আপনারা ভয় পাবেন না। এখানে ভয়ের ব্যবসা চলে না। অনেক দিন ধরে কথা বলার মতো উপযুক্ত মানুষ পাচ্ছি না। আপনাদের দেখে আজ খুবই ইচ্ছে করছে। তাই এই অসময়ে দেখা দিয়েছি। আমি আপনাদের সাথে গল্প করবো, বিভন্ন ঘটনা বলবো, কিছু জিনিস উপহার দিবো। এইটা আমার আস্তানা হলেও আমি থাকি আসমানে আসমানে, জমিনে জমিনে, পাতালে পাতালে। আমি বাতাসের সাথে উড়ি, পানির সাথে মিশি, মানুষের রগে রগে ঘুরি, মানুষের শিরা উপশিরায়, রক্তের কণিকা আমার আবাসস্থল। আপনাদের পথ দেখানোর জন্য আমার জন্ম। বিপদ থেকে আসান করার জন্য আমার সাধনা। কামরূপ কামাক্ষার জ্যান্ত গুহার ন্যাংটা বাবার কাছে আমার জন্ম।
নগরপিতা ও তার পরিবারের সদস্যরা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারা বুঝতে পারে না কী করবে। লোকটার কথাকে রহস্যময় ও ভৌতিক মনে হয়। কেবল কামরূপ কামাক্ষা নামটা পরিচিত লাগে। লোকটা কাছে ডাকে তাদের। তারা পুতুলের মতো, যন্ত্রের মতো চলে। লোকটা আবারো বলতে থাকে :
আমি খুব ভালো করে বুঝতে পারছি আপনারা ভয় পাচ্ছেন। আমি কিন্তু আপনাদের উপকার করার করার জন্য দেখা দিয়েছি। আমি যার তার সামনে দেখা দিই না। সেটা ভুলে যাবেন না, আপনাদের ভাগ্য ভালো। কামরূপ কামাক্ষায় আমার নতুন জন্ম হয়েছে। আপনারা হয়তো জানেন না, কোনো পুরুষ মানুষ কামরূপ কামাক্ষায় গেলে আর ফেরত আসতে পারে না। ওখানে কোনো পুরুষ বাঁচে না। বেঁচে আছেন শুধু জ্যান্ত গুহার ন্যাংটা বাবা আর আমি। কোনো পুরুষ যা পারে নাই আমি তা পেরেছি, এই আমি পেরেছি।
নগরপিতা তার নগরের মানুষের সাথে যেভাবে কথা বলেন সেভাবে কথা বলা শুরু করেন। তবে তার নগরের মানুষের মতো পরিবারের সদস্যরাও নিশ্চুপ। নগরপিতা আত্মবিশ্বাসের সাথে জানতে চান কামরূপ কামাক্ষায় পুরুষ মানুষ না বাঁচার কারণ। কামরূপ কামাক্ষার কথা কম বেশি শুনেছেন, কিন্তু এমন কোনো মানুষ নিজ চোখে দেখেননি যে কি-না ওই দেশ থেকে ফিরে এসেছে। কিন্তু লোকটা শর্ত দেয় যে এই ঘরে কোনো মেয়ে মানুষ থাকতে পারবে না। নগরপিতা সাথে সাথে তার স্ত্রী ও সাত বছরের মেয়ে মৃত্তিকাকে চোখের ইশারায় অন্য ঘরে যাবার নির্দেশ দেন। লোকটা বলা শুরু করে :
কামরূপ কামাক্ষা এক ভয়ংকর জায়গা। কিছু কথা খোলামেলা করে না বললে আপনারা বুঝতে পারবেন না। যেহেতু এখানে সবাই পুরুষ মানুষ তাই খোলাসা করেই বলি, আপনাদের বুঝতে সুবিধা হবে। ওখানে খালি মেয়ে আর মেয়ে। কোনো বুড়া মানুষ নাই, যে কয়জন আছে জোয়ান পুরুষ তারাও লিকলিকা। এই আছে, এই নাই। কারণ, পুরুষ মানুষ বেশি দিন বাঁচে না। আমার মতো দুয়েক জনকে পেলে প্রথমেই ওরা একটা শরবত খেতে দেয়। ওই শরবত খেলে পুরুষের অঙ্গ লোহার মতো শক্ত হয়ে যায়। হাজার বার সঙ্গম করলেও অঙ্গ নরম হয় না। একটা বাড়িতে মাত্র একটা বা দুইটা পুরুষ থাকে। বাড়ির সব মেয়েরা পালাক্রমে ওই পুরুষের সাথে মিলিত হয়। এক সময় পুরুষ মানুষটা হালকা হয়ে যায়। দিনে দিনে পুরুষটা শুকায়া যায়, কোমর ও পাছা চুপষে যায়, পেট বড় হয়ে যায়, চাপা ভেঙে যায়, চোখ গর্তের ভেতরে ঢুকে যায়। আস্তে আস্তে অসার ও দুর্বল হয়ে মরে যায়।
এই গল্প শুনে বিশেষ কিছু মনে হয় না কারো কাছে। আর এই গল্পইবা কেন বলছে? নগরপিতা বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করেন। ঠান্ডা মাথায় সমস্যা সমধান করার অভ্যাস আছে, সেই অভ্যাসের জোরে জানতে চান কামরূপ কামাক্ষার মতো ভয়ংকর জায়গা থেকে লোকটা কীভাবে ফিরে আসলো। লোকটা ভরাট কণ্ঠে বলতে থাকে :
আমার ভাগ্য ভালো, আমি সর্দারনির হাতে পড়ি। কোনো উপায় না দেখে আমি সর্দারনিকে মা ডাকা শুরু করি। মা ডাক শুনে সর্দারনি খেপে যায়। কিন্তু আমি পায়ে পড়ে কান্না করতে থাকি। এক সময় সর্দারনি আমাকে হাত ধরে তুলে তার ঘরে নিয়ে যায়। খুবই লজ্জার কথা, তাও আপনাদের শুনতে হবে। আমি সর্দারনিকে মা ডাকলে কী হবে, সর্দারনি ঘরে নিয়ে আমাকে ন্যাংটা করে ফেলে। সাথে সাথে আমার সাথে সঙ্গমে মিলিত হয়। কিন্তু সর্দারনি একটা বিরাট উপকার করে, আমাকে নেশাধরা শরবত খেতে দেয় নাই। তবে পাতার রস খেতে দিতো আর হাতের আঙ্গুলে একটা আংটি পরায়া দিতো। এতে আমি ঘোড়ার মতো শক্তি পেতাম। আমি সর্দারনির পালা গোলাম বা ছেলে ছিলাম বলে কোনো মেয়ে আমাকে নিয়ে টানাটানি করার সাহস পায় নাই। তবে একটা খারাপ কাজ করা হতো আমার সাথে। সর্দারনির কোনো ছেলে ছিলো না, ছিলো তিনটা মেয়ে। সবগুলা বড়ো বড়ো। ওরা আমার দিকে নজর দেওয়া শুরু করে, এক সময় আমার সাথে সবগুলা মেয়ে সঙ্গমে মিলিত হয়। আমি সর্দারনিকে বলে দিবো বললে আমাকে মেরে ফেলার ভয় দেখায়। কিন্তু পাতার রস খেয়ে আর আঙ্গুলে আংটি পরে আমার মতো ছেলে তাদের চার মা মেয়ের সাথে কুলাতে পারছিলাম না। আমার হাঁটুতে কোমরে ঘাড়ে, সারা শরীরে, হাড্ডির ভেতরে ব্যথা করতো, হাতে পায়ে চোখে মুখে প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া করতো। আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। পরে জ্যান্ত গুহার ন্যাংটা বাবার কারণে পালায়া আসতে পারি। আমার লাভের লাভ বলতে জ্যান্ত গুহার ন্যাংটা বাবার কাছ থেকে শেখা মন্ত্র ও কিছু জিনিস।
নগরপিতার পরিবারের সদস্যদেরও ভয় কমে। তবে তারা গল্পে মজে যাচ্ছে, আরো ঘোরের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে, কথার জাদুতে ডুবে যাচ্ছে, ঘটনার মায়াজালে জড়িয়ে যাচ্ছে। তারা খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চায় কী কী জিনিস আছে। নগরপিতার বৃদ্ধ পিতা অনুরোধ করলে লোকটা সিন্দুক থেকে পিতলের বাক্স বের করে আনে। সবাই আগ্রহ নিয়ে চেয়ে থাকে। সবার চোখ মুখ চকচক করে। লোকটা বাক্স থেকে একটা আংটি বের করে তড়তড় করে বলতে থাকে :
এই আংটি কামরূপ কামাক্ষার মোহধরা পাথর দিয়ে বানানো, এই আংটি আঙ্গুলে পরলে পাতাল নাগের মতো শক্তি আসে শরীরে, তখন একটা পুরুষ মানুষের অঙ্গে আট দশটা মেয়ে মানুষকে কাবু করার শক্তি আসে।
নগরপিতার বৃদ্ধ পিতা ও পুত্ররা আংটিটা হাত দিয়ে ধরে আঙ্গুলে পরতে যায়, কিন্তু লোকটা বলে এটা পরে দেওয়া হবে, নিশ্চয় দেওয়া হবে। তখন তাদের চোখ মুখ টনটন করে। বৃদ্ধ পিতার মনে হয়, আহারে এটা পাওয়া গেলে আবারো জীবনের স্বাদ নিতে পারতাম। পুত্রদের মনে হয়, ইশ, এটা যদি পেতাম তাহলে কতো মজা হতো, কয়েক দিন ধরে আগের মতো শক্তি পাচ্ছি না শরীরে। কিন্তু নগরপিতা অন্যমনষ্ক হয়ে অন্য কিছু আছে কি-না জানতে চান। লোকটা নগরপিতার দিকে বর্শার ফলার মতো চেয়ে থাকে। নগরপিতা কিছুটা অস্বস্তি বোধ করেন। লোকটা গম্ভীর হয়ে বাক্স থেকে একটা কাপড়ের টুকরা বের করে বলে :
এই যে আমার হাতে যে কাপড় দেখতে পাচ্ছো এটা কোনো স্বাভাবিক কাপড় না। এর ক্ষমতা অনেক। ক্ষমতার কথা শোনার আগে এটা কীভাবে পেলাম সেই ঘটনাটা শুনো। ঘটনা না শুনলে এটার মর্ম বুঝবে না। একদিন ঠিক দুপুরে আমি কামরূপ কামাক্ষার গহীন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে শুনি চ্যাল চ্যাল শব্দ হচ্ছে। কী যেন ফন ফন করছে। আমি সাথে সাথে দাঁড়ায়া যাই। আমি অনুমান করি, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। ডানে তাকায়া ভয় পেয়ে যাই। কিন্তু জ্যান্ত গুহার ন্যাংটা বাবার কথা মনে হলে সাথে সাথে আমার পরনের কাপড়টা খুলে ছুঁড়ে মারি। কী, বুঝছো কিছু? আরে নাগরাজ ও নাগরানির সঙ। আমার কী ভাগ্য ওরা সঙ ধরতে ধরতে আমার কাপড়ের উপর লুটিপুটি খায়। নাগরাজ নাগরানিকে এমনভাবে পেচায়া ধরে যে আর ছাড়ে না। সাত ঘন্টা পরে সঙ ছেড়ে কয়েকটা মোচড় দিয়ে হাওয়া হয়ে যায়। আমি তাড়াতাড়ি কাপড়টা নিয়ে আসি। কী মাতাল করা গন্ধ। শুঁকে দেখতে পারো গন্ধটা, এখনো আছে। এই কাপড় নিয়ে আমি যেখানে গেছি সেখান থেকেই জিতে আসছি। এই কাপড় যতদিন আমার কাছে আছে ততদিন দুই পায়ের কোনো প্রাণী আমাকে হারাতে পারবে না। জীবনেও পারবে না, মরণেও পারবে না।
নগরপিতার চোখ মুখ কান গরম হয়ে ওঠে, কাপড়টা হাতে নিয়ে দেখতে চান নাকের কাছে নিয়ে শুঁকতে চান; কিন্তু লোকটা হাত থেকে নিয়ে বলে এখন না পরে দেওয়া হবে। নগরপিতা কাপড়ের ঘোরে পড়ে, মনে মনে বলে এমন একটা কাপড় যদি থাকতো তবে আরো বড়ো কিছু হতে পারতো। পর পর তিন বার ভোটে বিজয়ী হবার পরে আরো বড়ো কিছু হবার শখ জাগে মনে। বৃদ্ধ পিতা ও পুত্ররা বিস্ময়ে চেয়ে থাকে। এবার বৃদ্ধ পিতার চোখ পড়ে বাক্সের এক কোণায়, সেখানে কিছু একটা দেখা যায়। খেয়াল করলে বোঝা যায় এটা একটা নির্জীব সাপ। কিন্তু দেখতে ছোট্ট লাঠির মতো, প্যাঁচানো, ফনা তোলা মাথায় চকচক করছে মণি। সবার চোখ পড়ে সাপের দিকে। তখন লোকটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে ‘এই সাপ মরা না, জীবিত।’ জীবিত সাপের কথা শুনে তারা নড়েচড়ে বসে। তারা সাহস নিয়ে সাপের ঘটনা জানতে চায়। লোকটা নগরপিতার স্ত্রী ও কন্যাকে ভেতরে আসতে বলে। বলে যে এখন যেসব ঘটনা বলা হবে তা সবাই শুনতে পারবে। ডাক দেওয়ার সাথে সাথে তারা ভেতরে প্রবেশ করে। হয়তো আশেপাশে ছিলো, হয়তো আড়াল থেকে সব শুনেছে। তাদেরকে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে। লোকটা সাপের ঘটনা বলতে থাকে :
আমাকে এই বিদ্যা শিক্ষা দেয় জ্যান্ত গুহার ন্যাংটা বাবা। বাবার কথামতো এক অমাবস্যা রাতে দেড়টার সময় পরনের সব কাপড় খুলে ফেলি। ঘর থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে আমার শরীর কেমন ঝারা মারে। শরীরের সমন্ত লোম হেজার কাঁটার মতো দাঁড়ায়া যায়। আমি দুই পা আগাই তো এক পা পিছাই। এমন করতে করতে শেষ রাতে বাঁশ ঝাড়ে পৌঁছাই। আমার হাতে রাম দা। এই দা দিয়েই কাজ করতে হবে। দিনের বেলা দেখে গেছি বাঁশটা। এই বাঁশ কিন্তু যেন তেন বাঁশ না। এই বাঁশ পুবের দিকে হেলে থাকে দক্ষিনের দিকে হেলে থাকে, এই বাঁশের আগাতে আছে তিন মস্তকওয়ালা ফুল। এই ফুল আনতে হবে। বাঁশ বায়া বায়া উঠি। এক কোপে ফুলসহ বাঁশের মাথা কাটতে হবে। আমি উঠি আর থরথর করে কাঁপি। কে যেন বাঁশ ধরে ঝাঁকায়। হাত ফসকে পড়ে গেলে আর রক্ষা নাই, সাথে সাথে রক্ত বমি হয়ে মরতে হবে। তাও বায়া বায়া উঠি। এক সময় বাঁশের আগায় উঠি, আমার ভারে বাঁশ নিচে নামতে থাকে। জ্যান্ত গুহার ন্যাংটা বাবার শিখিয়ে দেওয়া মন্ত্র পড়তে পড়তে এমন এক কোপ দিই যে বাঁশের মাথা নিয়ে পড়ি মাটিতে। ভাগ্য ভালো যে ব্যথা পাই নাই, তবে আমার সারা শরীর কাঁপতে থাকে।
এটুকু বলে লোকটা নিঃশ্বাস নেয়। নগরপিতা জিজ্ঞেস করে এই ঘটনার সাথে সাপের সম্পর্ক কী। আর সত্যিই এই সাপ জীবিত কি-না। লোকটা এমন ভাবে তাকায় যে চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হবে। লোকটা আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসছে আগেই, এখন তুই বলা শুরু করে, ‘আগে আমার কথা শুনবি নাকি এই সাপকে জীবিত করে ফেলবো?’
নগরপিতার কন্যা মৃত্তিকা জড়োসড়ো হয়ে মায়ের বুকে মুখ লুকায়। বৃদ্ধ পিতা পরের টুকু বলার জন্য অনুরোধ করে। পুত্রদের চোখে মুখে বিরাট বিস্ময়। লোকটা বলতে থাকে :
তিন মস্তকওয়ালা ফুল নিয়ে গাঙের কাছে যাই, এটা এমন এক গাঙ যে গাঙের পানি কোনো দিন উজায় না, খালি ভাটির দিকে যায়। বাম হাতে ফুল নিয়ে আস্তে আস্তে পানিতে নামি। সাথে সাথে চার দিক থেকে হাজার হাজার সাপ আসতে থাকে। আমার সারা শরীর কাঁপতে থাকে, হাত পা অবশ হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু মনে শক্তি আনার চেষ্টা করি। আমি জ্যান্ত গুহার ন্যাংটা বাবার শেখানো মন্ত্র পড়ে আগাতে থাকি। গাঙের পানি আমাকে বলে ‘যাইস না, যাইস না।’ চান্দের আলোতে সব দেখা যায়। নদীর মাঝখানে বিশাল দুই হাত। এক হাত দিয়ে ডাকে আরেক হাত দিয়ে না করে। এক হাত বলে ‘আয়, আয়।’ আরেক হাত বলে ‘আইস না, আইস না।’ ফিরে যাবারও কোনো উপায় নাই, গেলেই রক্ত বমি করে মরতে হবে। মন্ত্র পড়তে পড়তে মাঝ গাঙে উপস্থিত হই। গাঙের দাড় আমাকে ভাসায়া নিতে চায়। তারপর ঘটে আসল ঘটনা।
নগরপিতা চুপ করে বসে আছেন। নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফেলছেন না। মৃত্তিকার বড়ো বড়ো চোখে ভয়। পারে তো মায়ের পেটে ঢুকে যাবে। লোকটা হাসে আর বলে, ‘তোদের ভয় নাই, তোদের ভয় নাই।’
বৃদ্ধ পিতা আসল ঘটনা জানতে চায়, পুত্ররা জ্যান্ত গুহার ন্যাংটা বাবার কথা জানতে চায়। লোকটার চোখ মুখ লাল হয়ে ওঠে। শরীর ঢুলুঢুলু করে। হঠাৎ ধমক দিয়ে ওঠে :
ওই ছেলেরা, তোরা এতো জানতে চাস কেন? সব বলবো, সব বলবো তোদের। তোদের জন্যই আমি। তবে শোন্। আমি কামরূপ কামাক্ষা থেকে পালায়া আসতে পেরেছি ওই ন্যাংটা বাবার কারণে। বুঝছিস? জ্যান্ত গুহা কেন বলেছি, ওই গুহা কথা বলতে পারে। তুই গুহার সামনে দাঁড়ায়া কিছু বলবি, দেখবি সাথে সাথে জবাব আসবে। সেই গুহার ভেতরে ধ্যানমগ্ন থাকতেন ন্যাংটা বাবা। ভাগ্যের জোরে আমি সেই বাবার সান্নিধ্য পাই। বাবা আমাকে একশ একটা মন্ত্র শিখিয়েছেন। কিন্তু কামরূপ কামাক্ষা থেকে বের হবার মন্ত্র বাবার জানা ছিলো না। উনার জানা ছিলো মাত্র একটা উপায়। তোরা কি সেই উপায়টা জানতে চাস?
সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। কারো মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না। তারা যেন পুতুল হয়ে গেছে। নগরপিতা একবার শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যা বলে। লোকটা বলতে থাকে :
সেই উপায় জানার আগে মাঝ গাঙের আসল ঘটনাটা বলে নিই। আমি মাঝ গাঙে দাড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে মন্ত্র পড়ি আর তিন মস্তকওয়ালা ফুল নাড়াই। আমার চারপাশে হাজার হাজার সাপ। কিন্তু আমার কাছে ঘেঁসতে পারে না। হঠাৎ করে দেখি বিশাল এক ঢেউ তুলে কী যেন আসছে, কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারি এটা আসলে পাতাল নাগ। এমন ভাবে আসে যে তার ঢেউ ও শ্বাস আমার নাকে মুখে লাগে। আস্তে আস্তে আমার কাছে আসে, আমাকে ছোবল মারতে চায়, কিন্তু আমি বারবার তিন মস্তকওয়ালা ফুল সামনে ধরে দিই। এই ফুলের কারণে শত শত বার ছোবল মারতে গিয়েও মারতে পারে না। পাতাল নাগ এক সময় ক্লান্ত হয়ে তিন মস্তকওয়ালা ফুলের সামনে ফনা তুলে দোল খেতে থাকে। আমিও কায়দা করে আস্তে আস্তে ডান হাত পিছনে নিয়ে খপ করে ঘাড়ের মধ্যে ধরে ফেলি। সাথে সাথে সে আমাকে প্যাচায়া ধরে। আমি ন্যাংটা বাবার শেখানো সবচেয়ে ভয়ংকর মন্ত্রটা পড়তে থাকি। ধস্তাধস্তি করতে করতে রাত শেষ হয়ে যায়। আমি সূর্যের জন্য অপেক্ষা করি। পাতাল নাগ দুর্বল হতে থাকে। এক সময় সূর্যের আলো এসে পড়ে পাতাল নাগের মাথায় আর সাথে সাথে পাতাল নাগ শক্ত হয়ে লাঠি হয়ে যায়। আর এই লাঠিটা হলো সেই পাতাল নাগ। আমি ইচ্ছা করলে এখনই এই লাঠিকে পাতাল নাগে রূপ দিতে পারি। মাটিতে রেখে মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিলেই জ্যান্ত হয়ে যাবে, আবার মন্ত্র পড়লে সাথে সাথে লাঠি হয়ে যাবে।
লোকটা খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে জোরে জোরে বলতে থাকে। এই সাপ কী কী কাজে লাগবে তারও ফিরিস্তি দিতে থাকে। মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিলে এই সাপ গিয়ে একটা গাছের শেকড় নিয়ে আসবে। সেই শেকড়ের রস খেলে মরণকে ফেরানো যায়। লোকটা নিজেও কয়েকবার মরণ ফিরিয়েছে। বৃদ্ধ পিতার মনে হয় যে করেই হোক এই সাপকে জীবিত করতে হবে। তখন পুত্ররা ভয় থেকে মুক্তি পেতে কথা বলার চেষ্টা করে, কামরূপ কামাক্ষা থেকে বের হয়ে আসার একমাত্র উপায় জানতে চায়। লোকটা বলতে থাকে :
ন্যাংটা বাবার কিস্তি টুপি ছিলো একটা। এই টুপি যে পরে সে অদৃশ্য হয়ে যায়, সে সব কিছু দেখতে পারে, কিন্তু দুই পায়ের প্রাণী তাকে দেখতে পায় না। আমি সেই টুপি উপহার পাই, সেই টুপির কারণে কামরূপ কামাক্ষা থেকে পালায়া আসতে পেরেছি। এই হলো সেই টুপি।
লোকটা বাক্স থেকে টুপিটা বের করে দেখায়। পুত্রদের মনে হয়, এই টুপিটা নিতেই হবে। তারা টুপিটা ধরতে গিয়েও ধরতে পারে না। তখন নগরপিতার স্ত্রীর চোখ পড়ে সোনার কৌটার দিকে। সেও সাহস করে জিজ্ঞেস করে এটা কীসের কৌটা। লোকটা অদ্ভুত হাসি হেসে বলা শুরু করে :
এই কৌটার ভেতরে আছে জাদুর সুরমা, যে সুরমা চোখে দিলে যে কোনো নারীকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর লাগে। কেমনে এই কৌটা পেয়েছি তা শোনার দরকার নাই। মেয়ে মানুষের সামনে এই ঘটনা বলা যাবে না।
নগরপিতার স্ত্রী এক দৃষ্টিতে কৌটার দিকে চেয়ে থাকে। তার মনে হয় এই সুরমা পেলে কতো ভালো হতো। দিনে দিনে বয়সের ছাপ পড়ে যাচ্ছে চেহারায়।
লোকটা আরো কথা বলার চেষ্টা করে, বলে যে, এই রকম আরো অনেক কিছু আছে, অচিরেই তাদের সবাইকে উপহার দেওয়া হবে। এখন আর কথা বলা যাবে না, কোনো কিছু দেখানো যাবে না, সময় শেষ হয়ে গেছে। লোকটা এক এক করে কাপড়ের টুকরা, নির্জীব সাপ, টুপি, আংটি ও সোনার কৌটা বাক্সের মধ্যে ভরে সিন্দুকে রেখে দেয়। তারপর লোকটা খাবার দাবারের কথা বলে তাদেরকে অন্য ঘরে নিয়ে যায়। সেই ঘরে কতো রকমের খাবার। কিন্তু তারা কেউ খাবে না, তাদের ক্ষুধা নেই। তারা চোখ থেকে মন থেকে মগজ থেকে বাক্সকে সরাতে পারছে না। তাদের বুকের ভেতরে কেমন করে, চোখে ঘুম আসে না। হঠাৎ করে টুং করে ঘণ্টার শব্দ হয়। লোকটা বলে তার হাতে সময় বেশি নেই, তাকে বিশেষ কাজে পাশের ঘরে যেতে হবে, কিছুক্ষণ পরে চলে আসবে, এসে আরো জিনিস দেখাবে আরো গল্প শোনাবে, তারা যেন খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম করে। কিন্তু নগরপিতার পরিবারের কেউ ক্ষুধা অনুভব করে না। তারা খাওয়া দাওয়া ঘুম বা অন্য কোনো কিছুর প্রতি টান অনুভব করে না। তারা জিনিসগুলোর কথা ভুলতে পারে না, বাক্সের কথা ভুলতে পারে না।
লোকটা চলে যাবার সাথে সাথে নাকে অদ্ভুত ঘ্রাণ। কী মায়াবি ঘ্রাণ, নেশাধরা ঘ্রাণ, পাগল করা ঘ্রাণ। তারা ঘ্রাণের কাছে যেতে বাক্সের কাছে যেতে ব্যাকুল হয়ে পড়ে। তারা ঘ্রাণের নেশায় পড়ে, ঘোরের মধ্যে পড়ে অথবা ব্যাকুল হয়ে আস্তে আস্তে বাক্সের দিকে যেতে থাকে, পিঁপড়া যেভাবে মিষ্টির গন্ধ পেয়ে পিল পিল করে যায়। কেউ কাউকে কিছু বলে না, তারপরও তারা একসাথে সিন্দুকের কাছে পৌঁছে। কাছে দিয়ে বুঝতে পারে সিন্দুকের ভেতর থেকে ঘ্রাণ আসছে। তারা সিন্দুকের দরজা খোলার চেষ্টা করে। হাত দিয়ে ধরার সাথে সাথে দরজা খুলে যায়। দরজা খোলার সাথে সাথে ঘ্রাণে আকুল হয়ে ওঠে। তারা বুঝতে পারে আসলে ঘ্রাণের উৎস বাক্সটা। তারা কতোক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বুকের ভেতরে ধপধপ শব্দ করে। দুনিয়ার সমস্ত চিন্তা গ্রাস করে, তারা যেন পাগল হয়ে যাবে, তারা যেন উন্মাদ হয়ে যাবে। হাত পা কাঁপতে থাকে, সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে। নগরপিতা বাক্সে হাত রেখে থরথর করে কাঁপেন, কিন্তু সরিয়ে নেন না, ধরেই রাখেন। তারপর বাক্সটা দুই হাতে পেটের সাথে মিশিয়ে পাগলের মতো উন্মাদের মতো দৌড় শুরু করেন। সাথে সাথে অন্যরাও পিছু নেয়। চোখের পলকে তারা বাহিরে চলে আসে। বাহিরে বের হয়ে দেখে ঝলমলে আলোতে গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। তারা দ্রুততার সাথে গাড়ীতে উঠে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে গাড়ী চলতে থাকে। দেখতে দেখতে অনেক দূর পর্যন্ত চলে আসে। হঠাৎ তাদের মনে প্রশ্ন জাগে, গাড়ী ঠিক হলো কীভাবে? তারপর মনে পড়ে মৃত্তিকার কথা। বাক্স নিয়ে তারা এতো বেশি মগ্ন ছিলো যে একবারের জন্যও মৃত্তিকার কথা মনে পড়েনি। তখন তারা খুব বিব্রত বোধ করে, কিন্তু লোকটার কাছে গিয়ে মৃত্তিকাকে নিয়ে আসার কথা ভাবতেও পারে না। তারা শুধু এটুকু মনে করতে পারে যে, গতকাল মৃত্তিকার পরনে ছিলো সাদা রঙের জামা।