১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি যে খবরটি শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিল, সেই বিজয়ের খবরটি এসেছিল কামাল লোহানীর কণ্ঠে।
“আমরা বিজয় অর্জন করেছি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে।”
খুব সংক্ষিপ্তভাবে এক কথায় বলেছিলেন কামাল লোহানী, তারপর নিজেরা মেতেছিলেন বিজয় উদযাপনে, সেই সঙ্গে গোটা দেশও।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা বিভাগের প্রধান ছিলেন কামাল লোহানী; নানা রোগের পাশাপাশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৮৬ বছর বয়সে শনিবার চিরবিদায় নিলেন তিনি।
ছেলেবেলাতেই বাঙালির ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার পর প্রতিটি সংগ্রামে নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন কামাল লোহানী।
সেজন্য মৃত্যুতে তাকে স্মরণ করে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, “সাংস্কৃতিক আন্দোলনসহ বাঙালি সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে তিনি ছিলেন একজন পুরোধা ব্যক্তি।”
“আমরা একজন প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার অসাধারণ যোদ্ধাকে হারালাম,” বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কামাল লোহানীর জন্ম ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার খান সনতলা গ্রামে। তার নাম রাখা হয়েছিল আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী।
পাবনা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন ১৯৫২ সালে তিনি। পরে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন।
পাবনা জিলা স্কুলে শেষ বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে কামাল লোহানীর রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ১৯৫৩ সালে নুরুল আমিনসহ মুসলিম লীগ নেতাদের পাবনা আগমন প্রতিরোধ করতে গিয়ে তাকে কারাগারে যেতে হয়।
মুক্ত হতে না হতেই আবার ১৯৫৪ সালে গ্রেপ্তার হন কামাল লোহানী। সেই সময় তিনি কমিউনিস্ট মতাদর্শে দীক্ষিত হন।
পরের বছর আবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে একই কারাকক্ষে তার বন্দিজীবন কাটে।
পরে কমিউনিস্ট মতাদর্শ নিয়ে নেমে পড়েন সংগ্রামে, উচ্চ মাধ্যমিকের পর তাই তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আর এগোয়নি।
এর মধ্যে সাংবাদিকতা শুরু করেন ১৯৫৫ সালে দৈনিক মিল্লাত পত্রিকা দিয়ে। এরপর দৈনিক আজাদ, সংবাদ, জনপদ, বঙ্গবার্তা, পূর্বদেশ, বাংলার বাণী, দৈনিক বার্তায় গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাংবাদিকদের রুটি-রুজির আন্দোলনেও ছিলেন অগ্রভাগে। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন তিনি মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে কামাল লোহানীও তাতে যুক্ত হন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব নেন তিনি।
কামাল লোহানী ২০০৩ সালে এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, “এটা আমার কাছে গর্বের ব্যাপার যে, ৯ মাস যে যুদ্ধ আমরা করেছি, জয় মুহুর্তের খবরটি আমি সমস্ত পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষী মানুষ শুধু নয়, সমস্ত মানুষের কাছে আমরা মুখেই উচ্চারিত হল।”
তিনি বলেছিলেন, ওইদিন ওই বিশেষ বুলেটিনটি প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠেছিল গান- ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই…।’
কামাল লোহানীর ভাষ্যে – “যেহেতু আমি সংবাদ বিভাগের প্রধান ছিলাম, সেজন্য ওই দিনের (১৬ ডিসেম্বর) সংবাদ লেখার দায়িত্বটা আমার উপর পড়ল।
“আমি যে সংবাদটা লেখেছিলাম মাত্র পাঁচ লাইনের সংবাদ ছিল। তিন লাইন ছিল শুধু পাকিস্তানকে গালাগাল করার এবং দুই লাইন ছিল- আমরা স্বাধীন হয়েছি… ।”
“আত্মসমপর্ণের সংবাদ যখন আমরা পেলাম, তখন আমরা শিল্পী কলাকুশলী সবাই জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে হৈ হুল্লোর করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। যতদূর মনে পড়ে আশ-পাশের ঘর থেকে আমাদের জন্য মিষ্টি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল,” বলেছিলেন তিনি।
স্বাধীন বাংলা বেতারে ‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ’
স্বাধীনতার পর বেতারের পরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন কামাল লোহানী। প্রেস ইন্সটিটিউটেও কিছুদিন কাজ করেছেন তিনি।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দিকে মনোযোগী হন তিনি। ১৯৮১ সালে দৈনিক বার্তার সম্পাদকের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে নতুন উদ্যমে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন। পরে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
তবে এর শুরুটা হয়েছিল ষাটের দশকে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবর্ষ পালনে পাকিস্তানি নিষেধাজ্ঞা জারি হলে ছায়ানটের নেতৃত্বে কামাল লোহানী ও হাজারো রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক কর্মী সাহসী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
১৯৬২ সালে কামাল লোহানী ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। পরে ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন তার রাজনৈতিক আদর্শের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ক্রান্তি’।
ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর হয়ে গান গাইতেন আলতাফ মাহমুদ, শেখ লুৎফর রহমান, সুখেন্দু দাশ, আবদুল লতিফসহ প্রথিতযশা শিল্পীরা ।
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে পূর্ব বাংলার শিল্পীরা যে ভূমিকা রেখেছেন, তার সঙ্গেও কামাল লোহানী সম্পৃক্ত ছিলেন পুরোপুরি।
স্বাধীন বাংলাদেশে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গড়ে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকা রাখেন তিনি।
তবে এখনকার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের হালে হতাশ ছিলেন কামাল লোহানী।
এক বছর আগে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, “পাকিস্তান আমলে লবণের দাম বেড়েছিল, তখন গান লেখা হয়েছিল। কবিতা লেখা হয়েছিল। কিন্তু আজ দুইশ টাকার বেশি দাম উঠলেও তা নিয়ে কোনো গান লেখা হয় না, কবিতা হয় না।”
এখনকার সংস্কৃতিকর্মীদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন কামাল লোহানীর
উদীচী শিল্পী গোষ্ঠির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন কামাল লোহানী।
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর দুই দফা মহাপরিচালক ছিলেন।
একাত্তর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টাও ছিলেন কামাল লোহানী।
সাংবাদিকতার জন্য ২০১৫ সালে একুশে পদকে ভূষিত হয়েছিলেন তিনি।