সরকারি গুদাম থেকে টিসিবির পেঁয়াজ তুলে সরাসরি খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে ডিলার মেসার্স মেরিন জেনারেল স্টোর। রাজধানীর মোহাম্মদপুর ৫০/২ বছিলা রোড ঠিকানায় পণ্য নেওয়ার পথেই এ কাজটি করা হয়। একইভাবে কালোবাজারে টিসিবির পণ্য বিক্রি করেন ঢাকার আগারগাঁও তালতলার ডিলার মেসার্স পিয়ার এন্টারপ্রাইজ। ক্রেতার কাছে বিক্রি না করে পণ্য গোপনে অন্য গুদামে মজুত করে অপর ডিলার মেসার্স প্রভাতী স্টোর (১৮-৭ এ পূর্ব রাজারবাগ)।
করোনার সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে টিসিবির পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে অনেক ডিলার এ ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। তাদের অনেকেই সংস্থাটির পণ্য কালোবাজারে বিক্রি করেছেন। ওজনে কম দিয়েছেন। টাকার জাল রসিদ দিয়ে নিয়েছেন লাইসেন্স। এ ধরনের ৩৭ জনের লাইসেন্স বাতিল করেছে টিসিবি কর্তৃপক্ষ।
জানতে চাইলে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) যুগ্মপরিচালক (মুখপাত্র) হুমায়ুন কবির বলেন, সরকারের ভ্রাম্যমাণ আদালত, মনিটরিং টিম ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন সার্বক্ষণিক টিসিবির ডিলারদের কার্যক্রম তদারকি করছেন। এ সময় অনেক অসাধু ডিলার ধরা পড়েছেন। প্রাথমিকভাবে তাদের আর্থিক জরিমানা করা হয়। পরে তাদের কাছে জবাব চেয়ে নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু সঠিক জবাব না পাওয়ায় প্রধান কার্যালয় থেকে ডিলারের লাইসেন্স বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ডিলারদের এ কার্যক্রমে সরাসরি দুর্নীতি হয়েছে। ফলে শুধু লাইসেন্স বাতিল করলেই যথেষ্ট হবে না। এক্ষেত্রে ডিলারদের দুর্নীতি দমন কমিশনকে রেফার করা যেতে পারে। সংস্থাটি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে এটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তবে অসাধু ডিলারদের চিহ্নিত করে টিসিবি কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিয়েছে, এটি ভালো উদ্যোগ। এ কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কালোবাজারে পণ্য বিক্রি ছাড়াও টিসিবির লাইসেন্স নিয়েও দুর্নীতি হয়েছে। সরকারি দপ্তরটিতে কর্মরত সহকারী কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা (অফিসপ্রধান বরিশাল) মো. শহিদুল ইসলাম ডিলারশিপ নিয়েছেন স্ত্রী পারুল বেগমের নামে। ঢাকার কামরাঙ্গীরচর আশ্রাফাবাদের মাদবর বাজারে মেসার্স ইনসাফ ট্রেড লিংক প্রতিষ্ঠানের নামে তা নেওয়া হয়। ওই প্রতিষ্ঠানের প্রোপ্রাইটর মোসাম্মৎ পারুল বেগম। টিসিবির চুক্তিপত্রে ১৪(ট) নম্বর শর্ত ভেঙে এ ডিলারশিপ নেওয়া হয়। পরে ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় পারুল বেগমের লাইসেন্স বাতিল করা হয়।
এছাড়া একই পরিবারে স্বামী ও স্ত্রী দুজন দুটি ডিলারশিপ নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। জয়পুরহাট সদর চরমাথা গ্রামের মেসার্স রণি এন্টারপ্রাইজের মালিক মোছাম্মদ জান্নাতুল ফেরদৌসি এবং পূর্ব জানিয়ার বাগানের মেসার্স ভাই-বোন এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. জাহিদুল ইসলাম তাদের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রী। ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় মো. জাহিদুল ইসলামের ডিলারশিপ বাতিল করা হয়। এছাড়া টাকার জাল রসিদ বানিয়ে টিসিবি থেকে ডিলারশিপ নেওয়ার মতো জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। বগুড়া শেরপুর সড়কে মফিজ পাগলা মোড়ের সিয়াম স্টোরের মালিক ইমদাদুল হক মিজু এবং একই এলাকার সাজিদা ট্রেডার্সের মালিক মো. রফিকুল ইসলাম টাকার জাল বা নকল রসিদ দিয়ে টিসিবির কাছ থেকে ডিলারশিপ নিয়েছেন। কিন্তু পরে এটি ধরা পড়ে। টিসিবির পক্ষ থেকে তদন্তে প্রমাণিত হলে দুটি ডিলারশিপ বাতিল করা হয়।
জানা যায়, চলমান করোনা পরিস্থিতিতে টিসিবির পণ্য নিম্ন ও মধ্য আয়ের শ্রেণির মধ্যে ব্যাপক চাহিদার সৃষ্টি হয়। এ সময় বাজারে নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেড়েছে। এসব বিষয় মাথায় রেখে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কম মূল্যে টিসিবির পণ্য বিক্রির কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু এই সুযোগে অসাধু কিছু ডিলার পণ্য বিক্রির কার্যক্রমে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, যা অন্য সময়ের তুলনায় অনেক বেশি।
সূত্রমতে, পণ্য বিক্রয় কর্মসূচি চলার সময় ১৭-৮ এ পূর্ব রাজারবাগের প্রভাতী স্টোর এবং ডেমরা সারুলিয়ার ডগাড় নতুনপাড়ার ডিলার খোন্দকার স্টোর মালিক টিসিবির চিনি, ডাল ও পেঁয়াজ নিয়ে ভিন্ন একটি গুদামে রেখে দেন। কালোবাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে তিনি এই অবৈধ মজুত করেন। পরে এটি ধরা পড়লে তাদের লাইসেন্স বাতিলসহ জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আঞ্চলিক কার্যালয় ঢাকার টিসিবির ডিলার ১২-১ কেএম দাস টিকাটুলীর আঁখি মণি ট্রেডার্সের মালিক মো. আইয়ুব আলী এবং দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর ১২৩-১-১ রায়হান সুপার মার্কেটের হক ভ্যারাইটিজ স্টোরের মালিক ফজলুল হক টিসিবির ডাল বিক্রির সময় ক্রেতাদের ওজনে কম দিয়েছেন। এটি ধরা পড়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং টিমের কাছে।
এ ঘটনায় প্রথমে আইয়ুব আলীকে ১০ হাজার এবং ফজলুল হককে ৫ হাজার টাকা আর্থিক জরিমানা করা হয়। পরবর্তী সময়ে চুক্তির শর্ত ভঙ্গের অভিযোগে তাদের ডিলারশিপ বাতিল করা হয়। এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের হাজী কেবি ম্যানশনের ডিলার শাহ আলম টিসিবির পণ্য ভোক্তার কাছে বিক্রি না করে বাজারে অন্য দোকানে বিক্রি করে দিয়েছেন। পাশাপাশি টিসিবির পণ্য কালোবাজারে বিক্রি করেন পাবনা ঈশ্বরদী মুলাডুলি বাজারের লক্ষ্মী ট্রেডার্স ও সরকার ট্রেডার্স। দুজন ডিলার একই পরিবারের সদস্য। কালোবাজারে পণ্য বিক্রির সময় ধরা পড়েন এই ডিলাররা।
সূত্রে জানা যায়, কালোবাজারির সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের হাতে ধরা পড়েছে টিসিবির ডিলার চট্টগ্রাম হাটহাজারীর নন্দীর হাট বাজারের মেসার্স জননী স্টোর, কোতোয়ালি ফিরিঙ্গি বাজারের মেসার্স ট্রেড লিংক, বোয়ালখালীর চরণদ্বীপ ফকিরখালী বাজারের মেসার্স দিদারুল আলম, আনোয়ারা তুলাতুলী ডেন্টি বাজারের মেসার্স আল আমিন পেইন্ট। এছাড়া নেত্রকোনার পূর্বধলা শ্যামগঞ্জ গোহালাকান্দার হক এন্টারপ্রাইজ ও পূর্বধলা বাজারের সাখাওয়াত হোসেন খান, কেন্দুয়া রায়পুর বাজারের মোজাহিদ স্টোর, ঝালকাঠি সদরের স্যান্ডরোডের সাইনি এন্টারপ্রাইজ।
কালোবাজারে পণ্য বিক্রির মতো অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে যেসব ডিলারের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে ঝিনাইদহ সদর নতুন হাটখোলার ইকরাম ট্রেডার্স, হামদহের ইমরান ট্রেডার্স, নীলফামারী ডোমার রেলগেট মোড়ের মিঠুন স্টোর, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনীর আনোয়ার ব্রাদার্স।
এছাড়া ময়মনসিংহ সদরের সানকিপাড়ার ছাইদুল ট্রেডার্স, ফুলবাড়িয়া বাজারের আজিজ অয়েল মিলস ও ইসলাম অ্যান্ড ব্রাদার্স, ভালুকাজন বাজারের ইসলাম ফিলিং স্টেশন, আকুয়া ফুলবাড়িয়া বাস স্ট্যান্ডের মুহিত এন্টারপ্রাইজ, ফুলবাড়িয়া বাকতা বাজারের আলবি এন্টারপ্রাইজের নামও রয়েছে।
তালিকায় আরও রয়েছেন খুলনার খালিশপুর চিতালি বাজারের সুমি এন্টারপ্রাইজ ও জোড়াগেট ৯৫৪ খান সবুর রোডের আর্জেন্ট এক্সপ্রেস এবং ৩৭ নূর প্লাজা ময়লা তোলার ডিলার আজাদুর রহমান, রাজশাহীর পবা শফিকুল ইসলাম, জামালপুর ইসলামপুরের সমাজ উন্নয়ন বহুমুখী সমিতির মীর নুরুল ইসলাম, ইসলামপুর বাজারের রেজাউল ইসলাম, কিশোরগঞ্জের কাচারি বাজারের হক ট্রেডার্স।